যে কোনও স্বৈরাচারী শাসকই কোনও না কোনও সময় প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ব্যতিক্রম হচ্ছেন না। আমেরিকার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের সঙ্গে তিনি যেন সম্মুখসমরে নেমেছেন। হার্ভার্ডের ওপর একের পর এক ফরমান জারি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির ন্যায্য প্রাপ্য সরকারি অনুদান বন্ধ করে দিচ্ছেন। এইসব স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফেডেরাল কোর্টে মামলা করেছে হার্ভার্ড।
হার্ভার্ড ছাড়াও কলম্বিয়া সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হম্বিতম্বি চালিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। প্রতিবাদীর ভূমিকায় প্রথম এগিয়ে এল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ই। তাদের এই আইনি পদক্ষেপ সাহস জুগিয়েছে আমেরিকার শিক্ষা মহলকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ট্রাম্পের কীসের সংঘাত? আসলে সংঘাত ছাড়া থাকতে পারেন না ট্রাম্প।
কুর্সিতে বসে পরপর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মার্কিন নাগরিকত্ব, অবৈধ অভিবাসন, গণছাঁটাই ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে। তার মধ্যে আমেরিকায় জন্মালেই অভিবাসীর সন্তানের মার্কিন নাগরিকত্ব প্রাপ্তি বাতিলের নির্দেশিকাটিতে আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সম্প্রতি শীর্ষস্থানীয় মার্কিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিতে তৎপর ওয়াশিংটন।
গাজায় চলছে ইজরায়েলি হামলা। মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুর দাবি, আমেরিকার সম্মতিতেই আক্রমণ চালানো হচ্ছে। হার্ভার্ড সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদে ইজরায়েল-বিরোধী প্রচার চলছে। পড়ুয়াদের সিংহভাগ প্যালেস্তাইন আন্দোলন, হামাসের সমর্থক। ওয়াশিংটনের চোখরাঙানি কলম্বিয়া সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইজরায়েল-বিরোধী প্রচার বন্ধ করতে সফল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু হার্ভার্ড জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাকস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়বেন, কারা পড়াবেন, কী পড়ানো হবে ইত্যাদি হার্ভার্ডই ঠিক করবে জানিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকারি খবরদারি মানতে নারাজ। হার্ভার্ড সহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে ট্রাম্প প্রশাসন বারবার ইজরায়েল-বিরোধী প্রচারের জন্য সতর্ক করেছিল। তবে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষকে আলাদাভাবে ‘গোপন চিঠি’ পাঠায়। এই চিঠি প্রকাশ্যে না আনার জন্য সতর্কবাণীও ছিল। কিন্তু হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে।
শাস্তিস্বরূপ মার্কিন সরকার হার্ভার্ডের একের পর এক আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম বন্ধ হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। তারপর স্থগিত ঘোষিত হয়েছে হার্ভার্ডের স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ ১০০ কোটি ডলার। এছাড়াও বাতিল করা হয়েছে হার্ভার্ডের ন্যায্য প্রাপ্য আরও কিছু অনুদান। প্রাপ্য করছাড় বন্ধের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, পড়ুয়াদের ‘এই রাষ্ট্রবিরোধী’ মনোভাবের পরিবর্তনে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে হার্ভার্ডে বিদেশি পড়ুয়া ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এতসব হুংকার, অনুদান বন্ধ ইত্যাদি কোনও কিছুই অবশ্য টলাতে পারেনি হার্ভার্ডকে। বরং ট্রাম্পের এইসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন হার্ভার্ডের প্রাক্তনীরা। ভারতের আনন্দ মাহিন্দ্রা, পি চিদম্বরম, কপিল সিবালের মতো বিশিষ্টরা ম্যাসাচুসেটসের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে জন এফ কেনেডি এবং বারাক ওবামা হার্ভার্ডের প্রাক্তনী।
ট্রাম্প প্রশাসনেরও বেশ কয়েকজন সচিব এবং গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। নোবেলজয়ী বহু বিজ্ঞানীর গবেষণায় সহায়ক হয়েছে হার্ভার্ড। ওবামা ইতিমধ্যে ট্রাম্পের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তগুলির নিন্দায় সরব হয়েছেন। হার্ভার্ডের এই আইনি লড়াই ইতিমধ্যে শোরগোল ফেলে দিয়েছে মার্কিন মুলুকে। ট্রাম্পকে আরও চাপে ফেলতে প্রিন্সটন, হার্ভার্ড, ক্রাউন, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়, কানেক্টিকাট কমিউনিটি স্টেট কলেজ সহ আমেরিকার ১৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সমস্ত স্বৈরাচারী ফরমানের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর অভিযান করেছে। একটি যৌথ বিবৃতিও দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি।
একদিকে হার্ভার্ডের মামলা, অন্যদিকে আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মিলিত চাপ নিশ্চিতভাবেই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না ট্রাম্পকে। কবে দ্বৈরথে কোন পক্ষ শেষপর্যন্ত জয়ী হয়, সেটা এখনও অনিশ্চিত।