অতনু বিশ্বাস
দুনিয়ার রাজনীতি এবং দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশের ভোটে আমেরিকার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের আর সার্বিকভাবে বিবিধ মার্কিন নীতির যে একটা প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই আছে, এমনকি পরোক্ষভাবে হলেও, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকার কথা নয়। কোথাও মার্কিন দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভোটের বাজারে ডিভিডেন্ড দেয়, কোথাও আবার মার্কিন বিরোধিতাই ভোটের ময়দানে ম্যাজিক-মন্ত্র। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের প্রেসিডেন্সিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর সেই ট্রাম্প ২.০-র আমেরিকা বোধহয় বৈশ্বিক প্রভাবে ছাপিয়ে গিয়েছে আগেকার আমেরিকাকে।
ট্রাম্প কিন্তু তাঁর এই প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছেন ভোটে জিতেই জানুয়ারির ২০ তারিখ তাঁর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির জন্য শপথগ্রহণের আগে থেকেই। কারণ, ওভাল অফিসের দায়িত্বভার নেওয়ার আগে থেকেই ট্রাম্প ডেনমার্ক নিয়ন্ত্রিত স্বশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ডকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলছিলেন। এমনকি প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করেও তিনি গ্রিনল্যান্ড দখল করতে চান, এমন ইঙ্গিত বারবার দিয়েছেন ট্রাম্প।
গ্রিনল্যান্ডের সাম্প্রতিক ভোটে এর ফলাফল কিন্তু বলার মতো। বলাই বাহুল্য গ্রিনল্যান্ডবাসীরা ট্রাম্পের এই আগ্রাসী মনোভাবকে পছন্দ করেননি বড় একটা। ফলে নির্বাচনে জিতল একটা মধ্যপন্থী দল, যারা ডেনমার্ক থেকে পর্যায়ক্রমে গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষপাতী। বোঝাই যাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রিনল্যান্ডবাসী সেটাকেই মনে করেছেন ট্রাম্পের আগ্রাসনের সঙ্গে যুঝবার পক্ষে সবচাইতে উপযোগী পরিস্থিতি। জয়ী দলের নেতা হান্স-ফ্রেডেরিক নিয়েলসেন বারবার ট্রাম্পকে আক্রমণ করেছেন, তাঁকে বলেছেন গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে ‘হুমকি’।
তারপর এপ্রিলের শেষে হল কানাডার অকালনির্বাচন। সে কিন্তু একটা ঐতিহাসিক ভোট। সে ভোটও একেবারে ট্রাম্পময়। ভোটের তিন-সাড়ে তিন মাস আগেও জনমত সমীক্ষায় কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং তাঁর দল লিবারেল পার্টির ভরাডুবি প্রায় নিশ্চিত দেখাচ্ছিল। জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ ন্যানোস নামক এক সংস্থার করা প্রাক-নির্বাচনি সমীক্ষায় দেখা গেল বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে সমর্থন ৪৭ শতাংশ আর শাসক লিবারেল পার্টির পক্ষে জনসমর্থন মাত্র ২০ শতাংশ। অন্যান্য সংস্থার করা সমীক্ষার ফলেও মোটামুটি একই ছবি।
কিন্তু কুর্সিতে বসার আগে থেকেই ট্রাম্প কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে বসলেন প্রবলভাবে। বারবার। তৎকালীন কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে বারবার ‘গভর্নর ট্রুডো’ হিসেবে ব্যঙ্গ করতে থাকলেন। তার ওপর তো গোটা দুনিয়ার সঙ্গেই শুরু করলেন তাঁর শুল্ক-যুদ্ধ। আমেরিকা-কানাডা-মেক্সিকোর মধ্যের বাণিজ্য চুক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কানাডার ওপর শুল্ক চাপিয়ে দিলেন চড়া হারে। এসবের ফলশ্রুতিতে মারাত্মক চটল কানাডিয়ান জনতা। প্রবলভাবে উজ্জীবিত হল তাদের জাতীয়তাবোধ। ইতিমধ্যে ট্রুডোর জায়গায় কানাডার লিবারেল পার্টির নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মার্ক কারনি। ভোটের বাজারে কানাডিয়ানদের জাতীয়তাবোধকে আরও উসকে দিতে পারলেন কারনি। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কানাডার কনজারভেটিভ দলের নেতা পিয়ের পয়লিয়েভর এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের আদর্শগত মিল এবং সংযোগ সুবিদিত। এক, তীব্র ট্রাম্প বিরোধিতার আবহে এবং কানাডিয়ান জাতীয়তাবাদের উতল হাওয়ায় মুছে গেল ২০-২৫ শতাংশ বা তারও বেশি জনসমর্থনের ব্যবধান। উলটে এপ্রিলের ২৮ তারিখের ভোটে লিবারেলরাই পেল কনজারভেটিভদের থেকে আড়াই শতাংশ বেশি ভোট। যে পয়লিয়েভরের কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা মাস কয়েক আগেও ছিল প্রায় নিশ্চিত, ট্রাম্পের প্রভাবে এক ঘোলা জলের তীব্র আবর্তে তা ভেঙেচুরে হল একাকার। মোট কথা, কানাডার ভোটে ট্রাম্প-এফেক্ট যেভাবে কনজারভেটিভ পার্টিকে নিশ্চিত জয় থেকে টেনে নামিয়ে তাদের ভরাডুবি ঘটিয়েছে তা ভবিষ্যতে ভোট বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনায় এবং পলিটিকাল সায়েন্সের ক্লাসেও নানাভাবে উদাহরণ হিসেবে উল্লিখিত হবে।
যাই হোক, গ্রিনল্যান্ড কিংবা কানাডার ভোটপর্ব ট্রাম্পের ছায়ার নীচে গ্রহণে ঢাকা পড়া হয়তো স্বাভাবিকই ছিল, কারণ এদেরকে আমেরিকার অংশ করতে চেয়ে ট্রাম্প এদের জাতীয়তাবোধকে জাগিয়ে দিয়েছেন। একটা বড় অংশের মানুষ তাই ট্রাম্পবিরোধী হয়ে পড়েছেন। তাই যে পার্টি বা নেতার আমেরিকায় ট্রাম্প কিংবা তার দলের সঙ্গে মাখামাখি বা নীতিগত সংযোগ অথবা সাদৃশ্যও রয়েছে, তারা বিরাগভাজন হচ্ছেন জনগণের দরবারে। এমন ছবি কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ গ্রহের অন্যত্রও।
যেমন অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার ভোট হল মে মাসের ৩ তারিখ। সেখানেও কিন্তু ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি এবং প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন নানাবিধ কারণে। ডিসেম্বর নাগাদই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে বিরোধী জোট লিবারেল-ন্যাশনাল কোয়ালিশন বা এককথায় ‘কোয়ালিশন’ এগিয়ে আছে জনসমর্থনে। কিন্তু হঠাৎই যেন নেপথ্যে থেকেও রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন ট্রাম্প। দুনিয়াজুড়ে বাণিজ্য-যুদ্ধ নিয়ে তাঁর আগ্রাসন স্পষ্ট করলেন সুদূর ওয়াশিংটন, ডিসি-তে বসে। এবং বিরোধী নেতা পিটার ডাটন যদিও কোনওভাবেই ট্রাম্পের ‘ক্লোন’ রূপ ছিলেন না, কিন্তু ট্রাম্প ঘরানার রাজনীতি এবং ভাবমূর্তি থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেন না কিছুতেই। বিরোধীরাও তাঁকে জুড়তে চেয়েছেন ট্রাম্প ঘরানার সঙ্গে। ফলশ্রুতিতে ভোটে তাঁর ভরাডুবি হল। পুনর্নির্বাচিত হলেন অ্যালবানিজ এবং তাঁর দল।
দুনিয়ার অন্যত্রও কিন্তু নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রভাব স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে। যেমন সিঙ্গাপুরেও ভোট হয়েছে মার্চের ৩ তারিখ। সেখানে যদিও ৬৬ বছর ধরে ক্ষমতাসীন শাসকদল পিপলস অ্যাকশন পার্টির জয় নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না, ভোটাররা কিন্তু আবার বিপুলভাবে জয়ী করেছে তাদের। আসলে ট্রাম্প ঘোষিত অতি চড়া শুল্কহারের ফলে দুনিয়াজুড়ে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে নিজেদের দেশে রাজনৈতিক স্থিততাকেই বেছে নিয়েছে মানুষ। অর্থাৎ প্রকারান্তরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটে একটা নির্ণায়ক বিষয় হয়ে উঠছে অনেক দেশেই।
সামনেই ভোট রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াতে। ভোট আছে জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষেরও। এসব ভোটের ক্ষেত্রে এবং আগামীদিনে আরও অনেক দেশে ট্রাম্পের শুল্ক, তার অর্থনৈতিক প্রভাব, কোন নেতা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভালো করে দরদস্তুর করতে পারবেন, কোন নেতার নীতি বা কথাবার্তা ট্রাম্পের মতো, এসবের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
ওপরের আলোচনায় মনে হতে পারে যে, সাম্প্রতিক অতীতে যখন বিশ্বব্যাপী অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি অর্থাৎ ক্ষমতাসীনের বিরোধিতা করার মনোভাব এবং রক্ষণশীলতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছিল বেশ চড়া মাত্রায়, ট্রাম্পের প্রভাবে কিন্তু উলটে একটা সামাজিক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যা মধ্যপন্থী এবং বামপন্থী জোটগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করছে। সেই সঙ্গে ভোটাররা ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই বেছে নিচ্ছেন স্থিতিশীলতা। এর অর্থ কি এটাই যে ট্রাম্প এবং ট্রাম্পবাদ বিশ্বজুড়ে এতটাই সমর্থন হারিয়েছে যে ট্রাম্পের বাণিজ্য-যুদ্ধ এবং অন্যান্য নীতির আবর্তে ট্রাম্পবিরোধী দৃষ্টিকোণ এবং বক্তব্য অন্য দেশেও নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে?
তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, সেটাও কিন্তু ঠিক নয়। এজন্য আমাদের নিতে হবে আরও দুটো উদাহরণ। প্রথমটা হল ফেব্রুয়ারির জার্মানির ভোট। সে ভোটে অতি দক্ষিণপন্থী এবং ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ দল এএফডি-র ফল হয়েছে নজরকাড়া। এএফডি তাদের সর্বকালের সেরা ফল করেছে এই ভোটে। না জিতলেও হয়ে উঠেছে এক প্রধান শক্তি। আর দ্বিতীয় উদাহরণটা রোমানিয়ার। সম্প্রতি সেখানকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটে জিতেছেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অতিজাতীয়তাবাদী নেতা জর্জ সিমিয়ন। সিমিয়ন নিজেকে বর্ণনা করেছেন ট্রাম্পের স্বাভাবিক বন্ধু হিসেবে। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’-এর স্টাইলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পুনর্গঠন করতে চেয়েছে সিমিয়ন।
জার্মানি এবং রোমানিয়ার ভোট বোঝাচ্ছে, ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ হলে ভোটে হারতে হবে, বিষয়টার এতটা অতিসরলীকরণ সম্ভব নয়। উচিতও নয়। আসলে প্রতিটা দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্ন তাদের ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং মানসিকতা। এবং নেতারা ভোটের প্রচারে জনগণকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেন, সেটাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধ এবং তাঁর বিবিধ নীতি এবং কথাবার্তার প্রভাব পৃথিবীর নানা দেশের অন্তর্বর্তী রাজনীতিতে এতটাই পড়েছে যা নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে অনেক দেশের ভোটে। নিয়ন্ত্রক, তবে তার প্রভাব কিন্তু হতে পারে যে কোনও দিকেই। স্মরণকালের মধ্যে অন্য কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কি এমন ছাপ ফেলতে পেরেছেন বিশ্ব রাজনীতিতে?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক)