বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

একুশ শতকের নতুন সাম্রাজ্যবাদী ট্রাম্প

শেষ আপডেট:

 

  • অতনু বিশ্বাস

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রণ করেছে মানুষের জীবনযাত্রাকে। তার রূপচিত্র অবশ্য বদলায় সময়ের পথ বেয়ে। তেইশশো বছর আগে আলেকজান্ডার সুদূর গ্রিস থেকে পৌঁছেছিলেন ভারতবর্ষ পর্যন্ত। আটশো বছর আগে দুনিয়া দেখেছে এক দুর্দান্ত সাম্রাজ্য বিস্তারকারীকে- চেঙ্গিস খান। উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদও প্রবলভাবে বদলে দিয়েছে দুনিয়ার মানচিত্রকে। আর এখন সাম্রাজ্যবাদের এক নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে একুশ শতকের এক-চতুর্থাংশ পার করে।

প্রবল পরাক্রমশালী ডোনাল্ড ট্রাম্প চার বছর শাসন ক্ষমতার বাইরে থেকেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের জন্য শপথ নিতে চলেছেন জানুয়ারির ২০ তারিখ। কিন্তু এ যেন এক অন্য ট্রাম্প, যিনি স্লোগান তুললেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন।’ আদ্যাক্ষরগুলো নিয়ে যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘মাগা’ (‘MAGA’)। এই অক্টোবরে মেরিয়ম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি ‘মাগা’-কে নতুন শব্দ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে তাদের অভিধানে। ‘গ্রেট’ তো ভালোই, কিন্তু সেই মহানত্বর রূপরেখাটা কী? দেখা গেল, ‘মাগা’ কিন্তু প্রায় ‘মেগা’-র রূপ নিয়েছে। একদিকে দুনিয়ার দুই শক্তিধর শাসক ভৌগোলিক আয়তনে দেশের সীমা বাড়াতে মরিয়া। একজন ভ্লাদিমির পুতিন। যিনি পেশিশক্তির সাহায্যে দখল করে চলেছেন ক্রাইমিয়া, ডোনেটস্ক, খেরসন ইত্যাদি। অন্যজন শি জিনপিং। সকালে বিকেলে যিনি জপে চলেছেন ‘ওয়ান চায়না’-র মন্ত্র। ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের জন্য জিতেছেন ‘মাগা’-আমেরিকার শাসন-ক্ষমতা। তিনিই বা কম কীসে? তাঁরও হল খেয়াল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে এরিক পোস্ট করেছেন একটা মিম। সেখানে ট্রাম্প আমাজনের মাধ্যমে কিনছেন কানাডা, গ্রিনল্যান্ড আর পানামা খাল। আসলে আমেরিকাকে ‘গ্রেট’ করে তোলবার উপায় হিসেবে ট্রাম্প এই জায়গাগুলিকে আমেরিকার মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করতে চান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ই-কমার্স সংস্থাগুলি এখনও তাদের বিক্রির তালিকায় এসব রাখেনি। তাই ট্রাম্পকে অন্য পথ ধরতে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, তিনি প্রয়োজনে মিলিটারি শক্তি দিয়ে দখল করবেন গ্রিনল্যান্ড আর পানামা ক্যানাল-কে। আর কানাডার জন্য ‘অর্থনৈতিক শক্তি’-ই যথেষ্ট। ব্যাপারটা একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

কানাডার প্রতিরক্ষা খাতে বেশ খানিকটা খরচ হয় আমেরিকার। সে নিয়ে এবং কানাডা থেকে গাড়ি, কাঠ আর দুগ্ধজাত দ্রব্য আমাদানিতে আমেরিকার যে বাণিজ্য ঘাটতি হয় তাতে ট্রাম্প বেশ অসন্তুষ্ট কিছুদিন ধরেই। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ট্রাম্প কানাডা আর মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিলেন। যা স্পষ্টতই আমেরিকা-মেক্সিকো-কানাডার বাণিজ্য চুক্তির পরিপন্থী। তবে তিনি চুক্তি মেনে কাজ করেন, এমন অপবাদ বোধকরি ট্রাম্পকে কেউই দিতে পারবে না। এই হুমকি কানাডার অর্থনীতিতে একটা বড়সড়ো আঘাত নিশ্চয়ই। বাধ্য হয়েই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে যেতে হল ফ্লোরিডা-তে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য। কিন্তু মার-আ-লাগো’তে ট্রুডোর সঙ্গে ডিনার করার পরেই ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখলেন, ‘গভর্নর জাস্টিন ট্রুডো অফ দ্য গ্রেট স্টেট অফ কানাডা’। অর্থাৎ কানাডা-কে আমেরিকার রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করলেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প বলেছেন, কানাডা যদি আমেরিকার ৫১তম রাজ্য হিসেবে যোগ দেয় তবে রাশিয়ান আর চিনা জাহাজের বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করবে আমেরিকা। সঙ্গে কর কমবে কানাডিয়ানদের, থাকবে না বাণিজ্য শুল্ক। অবাক বিষয় যে, কানাডিয়ানরা খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না এই ‘অফার’-এ। কানাডিয়ান মার্কেট রিসার্চ সংস্থা ‘লেজার’-এর ডিসেম্বরের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১৩ শতাংশ আগ্রহ দেখিয়েছে কানাডায় যোগ দিতে, আর ৮২ শতাংশ আগ্রহী নয় ট্রাম্পের এই প্রস্তাবে। এমনকি অন্টারিও-র প্রধান ডগ ফোর্ড মজা করে বলেছেন, পরিবর্তে কানাডা ভাবতে পারে আলাস্কা, মিনেসোটা আর মিনিয়াপোলিস কেনার কথা।

বিশ্ব-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পানামা ক্যানালের গুরুত্ব অসীম। ক্যানালটি যুক্ত করেছে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসমুদ্রকে। ১৯৭৭-এর টোরিয়স-কার্টার চুক্তি ১৯৯৯-এর মধ্যে পানামা ক্যানালের পরিচালন-ভার তুলে দিয়েছে পানামার হাতে। ট্রাম্প এখন ক্যানালের নিয়ন্ত্রণ চান আমেরিকার হাতে। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি কিংবা প্যারিস পরিবেশ চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া তো আগেই দেখেছে দুনিয়া। পানামা খালের ক্ষেত্রে ট্রাম্প অবশ্য অভিযোগ করেছেন, এই জলপথ ব্যবহারের জন্য পানামা অতিরিক্ত মূল্য নিয়েছে আমেরিকার কাছ থেকে, আর এই জলপথের বেশি সুবিধা নিয়ে চলেছে চিন।

এবার আসা যাক গ্রিনল্যান্ডের কথায়। ডেনমার্কের অধীনে এক স্বয়ংশাসিত ভূখণ্ড এই গ্রিনল্যান্ড। আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়েছে আগেও। ১৮৬৭-তে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন যখন রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কেনেন আমেরিকার জন্য, সে সময় তিনি নাকি গ্রিনল্যান্ড কেনার কথাও ভেবেছিলেন। তারপর ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তীব্র টানাপোড়েনের আবহে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য ডেনমার্ককে ১০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সোনা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ডেনমার্ক কিন্তু এই প্রস্তাবকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। ট্রাম্প কিন্তু ২০১৯ থেকেই বলে আসছেন, আমেরিকার পক্ষে গ্রিনল্যান্ডের দখল নেওয়া আর তার নিয়ন্ত্রণভার হাতে নেওয়া অবশ্য প্রয়োজনীয়। সেকথা এখন আবার বলছেন ট্রাম্প। বলছেন, যেভাবেই হোক, তাঁর গ্রিনল্যান্ড চাই। ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ‘মেক গ্রিনল্যান্ড গ্রেট এগেন’। আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘MGGA’ কি তাহলে মেরিয়ম-ওয়েবস্টারের নতুন শব্দ হতে চলেছে?

কিন্তু কেন? ডেনমার্ক তো আমেরিকার বন্ধু দেশ, ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশগুলির অন্যতম। তাহলে তাদের চটিয়ে তাদের অংশ পেতে কেন মরিয়া ৭৮ বছরের মার্কিন ভাগ্যনিয়ন্তা? তবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে যে, ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদের চেহারাটা কিন্তু উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদের থেকে ভিন্ন। এ যেন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ব্যবস্থায় কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন। তবে তা ট্রাম্পের নিজস্ব স্টাইলেই।

আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ও প্রধান পরিচয় এটাই যে, তিনি এক দুঁদে ব্যবসায়ী। তাঁর এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে তাঁর প্রত্যেকটি পদক্ষেপে। অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক সমীকরণে। কানাডাকে অধিগ্রহণ করতে চাওয়ার মধ্যে রয়েছে সুমেরু বৃত্তের কাছে রাশিয়া আর চিনের অনুপ্রবেশ রুখবার প্রচেষ্টা। কিন্তু সেইসঙ্গে এই সুমেরু অঞ্চলে- গ্রিনল্যান্ড আর কানাডা যার অংশ- রয়েছে দুনিয়ার অনাবিষ্কৃত গ্যাসের ৩০ শতাংশ, অনাবিষ্কৃত তেলের ১৩ শতাংশ, আর আনুমানিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের দুষ্প্রাপ্য খনিজ ধাতু।

এ ছাড়াও ট্রাম্প গালফ অফ মেক্সিকোর নাম বদলে গালফ অফ আমেরিকা করে দিতে চাইছেন, ন্যাটোর সদস্য দেশগুলির অবদান ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করতে চেয়েছেন। আমেরিকা মহাদেশটা দু’দিকে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর। তাই বোধকরি ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদ আপাতত দুই মহাসমুদ্রের মধ্যেই আটকে রয়েছে।

ট্রাম্পের এই অধিগ্রহণের প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়েছে কানাডা, ডেনমার্ক বা পানামা। অবশ্য ট্রাম্প কানাডা অধিগ্রহণে সত্যিই কতটা আগ্রহী হবেন, বলা কঠিন। কানাডার জনসংখ্যা ক্যালিফোর্নিয়ার চাইতে সামান্য বেশি। তাই কানাডা যদি আমেরিকার ৫১তম রাজ্য হয় তবে তা অন্তত ৫৪টা ইলেক্টোরাল ভোট দেবে মার্কিন নির্বাচনে। এবং ডেমোক্র্যাটদের। আমেরিকায় রাজ্যগুলির সব ভোট পায় সেই দল যারা রাজ্যটায় বেশি ভোট পায়। তাই কানাডা ৫৪টি ইলেক্টোরাল ভোটের জোগান দেবে ডেমোক্র্যাটদের, যার ফলশ্রুতিতে আমেরিকা ঝুঁকে পড়বে ডেমোক্র্যাটদের দিকে। বদলে যাবে দেশটার রাজনীতির ভারসাম্য। তাই রিপাবলিকানরা কিছুতেই চাইবে না তা। তাই অন্তত কানাডা নিয়ে ট্রাম্পের হম্বিতম্বি বোধকরি প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্ক নিয়ে হইচইকে প্রশমিত করার জন্য।

কানাডা, গ্রিনল্যান্ড বা পানামা ক্যানাল আমেরিকার আয়ত্তে না এলেও ট্রাম্পের হইচই-এর ফলে দরাদরিতে এই অঞ্চলগুলিতে আমেরিকার প্রভাব হয়তো খানিক বাড়বে। সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রাম্প পোস্ট করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্মিত ছবি। একটা ছবিতে পানামা ক্যানাল-এর ওপরে আমেরিকার পতাকা, সঙ্গে লেখা ‘ওয়েলকাম টু দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ক্যানাল’। আর একটি ছবিতে ট্রাম্প, আমেরিকার পতাকা, আর দূরে একটা পর্বত। সঙ্গে লেখা ‘ও কানাডা’। ঘটনা হল, ছবির পর্বতটা সুইস আল্পস। সাম্রাজ্যবাদের রঙেরসে চুবিয়ে ট্রাম্প যে স্বর্ণযুগ আনতে চাইছেন আমেরিকার জন্য তা একই রকমের হাস্যকর হয়ে উঠবে?

(লেখক কলকাতা আইএসআইয়ের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

বৃক্ষই নাম বদলে হতে পারে বিবাহ

  সুনন্দ অধিকারী শিরোনামই বলছে বিবাহ ও গাছকে একসূত্রে গাঁথতে।...

উষ্ণায়ন কমাতে অস্ত্র যখন তরল গাছ

  বিমল দেবনাথ বাড়বাড়ন্ত তাপ প্রলম্বিত করছে গ্রীষ্ম। দিন-দিন রূপ...

আর কবে ইন্দো-ভুটান নদী কমিশনের কাজ

সুকল্যাণ ভট্টাচার্য্য ইন্দো-ভুটান যৌথ নদী কমিশন গঠন সংক্রান্ত কোনও আলোচনা...

ঘুম নেই, ঘুম নেই নারীদের চোখে

মৌমিতা আলম “আহার নিদ্রা ভয়, যতই বাড়াবে ততই হয়…” সকালবেলা ঘুম...