শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

অসহনশীলতার দুই দিক

শেষ আপডেট:

সহনশীলতা তলানিতে। প্রকৃতিতে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেও। মাত্রাতিরিক্ত বর্ষণ হয়েছে পাহাড়ে। যার মাটি ভঙ্গুর। যে মাটি বড়জোর ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি সইতে পারে। সেখানে মাত্র ৫ ঘণ্টায় গড় বৃষ্টি ২৬১ মিমি। সহনশীলতার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে যেজন্য। হুড়মুড়িয়ে ধস নেমেছে পাহাড়ে। ওই বৃষ্টি যে জলধারা তৈরি করেছিল, তা বহন করার ক্ষমতাও আর নেই পাহাড়ি নদী ও ঝোরাগুলির।

ফলে ধসে চাপা পড়েছেন মানুষ। ভেঙে গিয়েছে বাড়িঘর। জলের তীব্র স্রোত চলার পথে সেতু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আশপাশের বাড়ি, নির্মাণ টেনে নামিয়েছে নদীগর্ভে। সহ্যক্ষমতার অতিরিক্ত ভার চাপানোর খেসারত দিয়েছে প্রকৃতি। মানুষের অসচেতনতা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। মনে করিয়ে দিয়েছে, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশের মতো দুর্যোগ বাংলার এই পাহাড়ি অঞ্চলের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। আগেও একবার সিকিমের লোনাক হ্রদের বিস্ফোরণ এরকম পরিণতির আভাস দিয়ে রেখেছিল।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধও ক্রমশ সহনশীলতা হারাচ্ছে। প্রকৃতির ধ্বংসলীলার পর সেই অসহনীয়তাও ডানা মেলল উত্তরবঙ্গে। বিরোধী শিবিরের দুই জনপ্রতিনিধিকে চরম হেনস্তা করা হল ডুয়ার্সে। একজন সাংসদ, অন্যজন বিধায়ক। দুজনই বিজেপির। দুজনই উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। পাথর ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করা হল উত্তর মালদার সাংসদ খগেন মুর্মুকে। টানাহ্যাঁচড়া থেকে শুরু করে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হলেন শিলিগুড়ির বিধায়ক শংকর ঘোষ। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরেছেন তাঁরা।

অপরাধ? দুর্যোগে বিধ্বস্ত এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের সেই অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু নাগরাকাটার কাছে একদল লোক সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করলেন। হাতে কোনও পতাকা না থাকলেও স্লোগানে স্পষ্ট তাঁরা শাসক শিবিরের অনুগামী। তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্ব এই হামলার নিন্দা করেনি। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এধরনের হামলায় অনুমোদন আছে দলের।

প্রকৃতির মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর ভারী বোঝা নামিয়ে দেওয়ার ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। সহনশীলতার মাপকাঠি অগ্রাহ্য করার পরিণাম উভয় ক্ষেত্রেই ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা স্পষ্ট। এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাহাড়ের মিরিক এলাকা। সৌন্দর্যায়ন, নগরায়ণ ও উন্নয়নের নামে যেখানে গত পাঁচ বছরে পাহাড়ি ঢাল কেটে, বৃক্ষনিধন করে বেআইনি নির্মাণের ঢল দেখা গিয়েছে। যে গাছ পাহাড়ের মাটিকে ধারণ করে রাখে, নির্বিচারে তাকে ধ্বংস করা হয়েছে।

ফলে সহনশীলতার অতিরিক্ত ভারী বর্ষণে নেমে আসা জল ধারণ করার মতো গাছ আর ছিল না। সেই বাড়তি জলধারায় মাটি আলগা করে বিপদ ডেকে এনেছিল পাহাড়ে। যে জল ধারণ ও বহন করার ক্ষমতা নদীগুলিরও আর নেই। যা নদীর ওপর বেআইনি নির্মাণ, জলাধার, বাঁধ নির্মাণের পরিণতি। ফলে জলস্ফীতি ঘটে নদীগুলিতে। সেই তীব্র জলধারা কোথাও ভাসিয়ে দিয়েছে সেতু, কোথাও টেনে নদীগর্ভে টেনে নামিয়েছে দু’পাড়ের বাড়িঘর, আবাদ ইত্যাদিকে।

বিজেপির দুই জনপ্রতিনিধির ওপর আক্রমণ তেমনই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিপর্যস্ত করে দিল। একইদিনে উত্তরবঙ্গে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ২৮টি প্রাণ নষ্ট হওয়ার পরেও যাঁর বিরুদ্ধে কলকাতায় জাঁকজমক করে কার্নিভাল পালন করার অভিযোগ উঠেছে। এরপর সেজন্য যদি ক্ষোভ আছড়ে পড়ে, তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বা সৌজন্যও যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এই অসহনশীলতা তৈরি হলে তা ক্রমশ একনায়কতন্ত্রের দিকে যায়।

এজন্য শুধু তৃণমূলের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। বিজেপি শাসিত রাজ্যে একইভাবে অন্য বিরোধীরা শাসকের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একই ছবি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ডিএমকে’র শাসনাধীন তামিলনাড়ু ও বাম শাসক কেরলে। সার্বিকভাবে অগণতন্ত্রের পথে হাঁটছে প্রায় সব দলগুলি। শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের অন্ধ বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল ধারণাটিকে গলা টিপে মারা হচ্ছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

প্রশ্নে বিশ্বাসযোগ্যতা

নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন রাহুল...

শক্ত কাজ 

ক’দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাড়িতে বাড়িতে নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠেছে। ২০০২...

ছকবাজি

‘মারি অরি পারি যে কৌশলে।’ মেঘনাদবধ কাব্যে কথিত এই...

ধমনীতে দূষিত রক্ত

রক্তের টান অত সহজ কথা নয়। শিকড়ের টানের মতো।...