বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

পদত্যাগের আড়ালে

শেষ আপডেট:

২১ মাস ভ্রাতৃঘাতী হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা মণিপুরকে আরও একবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে হঠাৎ পদত্যাগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। এই পদত্যাগের নানাবিধ কারণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইতিপূর্বে বারবার তাঁর পদত্যাগের দাবি উঠলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা-রাও সেই দাবিতে খুব গা করেননি।

এর মধ্যে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ স্বেচ্ছায় বলা যাবে না। মহাকুম্ভে পুণ্যস্নানের পর তাঁর আচমকা পদত্যাগের নেপথ্যে মণিপুরের হিংসা বন্ধ করতে না পারার আত্মগ্লানিই মূল কারণ- সেটাও বলা যাবে না। বরং এই পদত্যাগের নেপথ্যে মণিপুরে বিজেপি শাসিত সরকারের পিঠ বাঁচানোর প্রবল দায় স্পষ্ট।

এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের চাপেই বীরেন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ মেইতেই-কুকি সম্প্রদায়ের হিংসার মোকাবিলায় রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হিসেবে প্রথম দিন থেকে ব্যর্থতার কারণে তাঁকে অনেক আগেই অপসারণের প্রয়োজন ছিল। এ ব্যাপারে বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করেছে কেন্দ্র এবং বীরেন সিং। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মণিপুরে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

উত্তর-পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র বুধবার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার আগে বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলেন। বীরেনের বদলে কাকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আনা হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। শেষপর্যন্ত নতুন কাউকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হলে এ যাত্রায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারির হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে মণিপুর। যদি তা না হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি শাসন অবধারিত।

১০ ফেব্রুয়ারি থেকে মণিপুর বিধানসভার অধিবেশন শুরুর কথা থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী পদে বীরেনের ইস্তফার কারণে রাজ্যপাল অজয়কুমার ভাল্লা ওই অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেছেন। মণিপুরের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বিধানসভার এই অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা করেছিল। মোদি-শা’র শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বইয়ে মণিপুরে বিজেপিতে বীরেন সিংয়ের বিরুদ্ধ গোষ্ঠী ওই অনাস্থা প্রস্তাবে সায় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

বিধানসভার সমীকরণ দ্রুত বদলাতে থাকায় বিজেপির পক্ষে মণিপুরে ক্ষমতা ধরে রাখা মুশকিল মনে হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে বীরেনের পদত্যাগ মণিপুরে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে গেরুয়া শিবিরকে খানিকটা স্বস্তি দিয়েছে। যদিও এত কাণ্ডের পরও মণিপুরে শান্তির হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বরং মেইতেই বনাম কুকিদের জাতিগত হিংসা মণিপুরকে ভিতর থেকে বিভাজিত করে ফেলেছে।

মোদি-শা’র কাছে বীরেনের মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকেও মণিপুরে ক্ষমতা ধরে রাখা অধিক জরুরি। সেজন্য প্রয়োজনে হাজার বীরেনকে ছেঁটে ফেলতেও দ্বিধা হবে না তাঁদের। অশান্তির ২১ মাসের সময়কাল সামান্য না হলেও তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একবারের জন্যও মণিপুর নিয়ে কোনও শব্দ খরচ করেননি। তিনি রাশিয়া গিয়েছেন। ইউক্রেনে গিয়েছেন। দুই দেশের যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অন্য অনেক দেশে সফর করেছেন। একাধিক দেশের শীর্ষ নাগরিক সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু রাহুল গান্ধি সহ বিরোধী শিবিরের অনেক নেতার বারবার দাবি সত্ত্বেও মণিপুরে একবারের জন্য যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি।

বোর্ডের পাশাপাশি জীবনের পরীক্ষায় সফল হতে পরীক্ষা পে চর্চায় পড়ুয়াদের যিনি ভোকাল টনিক দিতে পারেন, হিংসাপীড়িত মণিপুরকে শান্ত এবং স্বাভাবিক করতে তাঁর মন কি বাতে কিছু বলার সময় হয় না। দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরদিনের মতো যে বিভেদের বীজ বপন হয়ে গিয়েছে, তার থেকে মুক্তির দিশা এখনও পর্যন্ত দেখাতে পারেননি মোদি-শা। আগামীদিনেও তাঁরা এই কাজটি করবেন কি না অনিশ্চিত।

বীরেন সিংয়ের পদত্যাগের নাটকে নয়াদিল্লির বিজেপি নেতারা পুলকিত হলেও মণিপুরবাসীর জীবনে পরিবর্তনের কোনও আশু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পদ্মের চালে তসলিমা  

চৌষট্টি খোপের দাবায় রাজা-মন্ত্রী, হাতি-ঘোড়া-নৌকার চেয়ে বিপদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে...

সর্বব্যাপী নীতিহীনতা

রাজনীতিতে দলবদলের প্রসঙ্গ উঠলে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ কাহিনী আসবেই। বহুলপ্রচলিত...

সুখের খোঁজ

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘সবাই তো সুখী হতে...

অনগ্রসরতা ও রাজনীতি

ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। মামলাটি...