বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫

University | উচ্চশিক্ষা নিয়ে ছেলেখেলা

শেষ আপডেট:

শিক্ষা দপ্তরের উদাসীনতা ও চূড়ান্ত অবহেলায় ভেঙে পড়ার মুখে উত্তরবঙ্গের উচ্চশিক্ষার কাঠামো। প্রশাসনিক অচলাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশৃঙ্খলা ক্রমেই বাড়ছে। আজ তৃতীয় কিস্তি

শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: ক্লাস করার সুযোগই পাচ্ছেন না ছাত্রছাত্রীরা, পাঠক্রম শেষ হওয়ার আগেই বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে তাঁদের। যার দরুন স্নাতক স্তরে ফি বছর ফেলের হারে রেকর্ড গড়ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় (University)। কলেজের আঙিনায় পা দিয়েই জোর ধাক্কা লাগছে পড়ুয়াদের মনে। নতুন শিক্ষানীতি চালু হলেও বাস্তবে আজ পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করতে পারেনি রাজ্য শিক্ষা দপ্তর। উচ্চশিক্ষার নামে কার্যত ছেলেখেলা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। ফলে দিশাহীন হয়ে পড়ছেন ছাত্রছাত্রীরা। উত্তরবঙ্গের (North Bengal) মতো আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকায় সমস্যা আরও বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বিষয় বা পাঠক্রম সম্পর্কে কোনও ধারণাই তৈরি হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীদের। ভর্তির আবেদন করতে গিয়ে কিছু না বুঝেই ক্যাফেওয়ালাদের পছন্দমতো বিষয় নির্বাচন করে হাবুডুবু খাচ্ছেন তাঁরা।

৭ মে উচ্চমাধ্যমিকের (HS Result 2025) ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। আর অনলাইনে কেন্দ্রীয় পোর্টালে কলেজগুলিতে স্নাতক স্তরের ভর্তির আবেদন জমা দেওয়া শুরু হয়েছে তার চল্লিশ দিন পর ১৭ জুন থেকে। ইতিমধ্যেই ভর্তির আবেদনের সময়সীমা বাড়িয়ে ১৫ জুলাই করা হয়েছে। বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষকরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, সেই সময়সীমা আরও কয়েক দফায় বাড়তে পারে। আবেদনের পর ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে করতেই পুজোর ছুটির ঘণ্টা বাজবে। আর ছুটি শেষ হলেই শুরু হবে প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষা। সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের জন্য বড়জোর মাসখানেক সময় পাবেন বলেই জানিয়েছেন বেশিরভাগ শিক্ষক।

উত্তরের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দু’চারদিন বেশি সময় পেলেও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা ৪৯টি কলেজে সময় মেলে আরও কম। কারণ ২৫ ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ের কলেজগুলিতে শীতকালীন ছুটি শুরু হয়। কলেজ খোলে মার্চ মাসে। অভিন্ন নীতি মেনে পাহাড় ও সমতলে একসঙ্গে স্নাতক স্তরের পরীক্ষা নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

আবার শীতকালীন ছুটির আগেই পরীক্ষা না নিলে নতুন ব্যবস্থাপনায় বছরখানেক পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সিমেস্টারের পরীক্ষা শেষ হয় ২৫ ডিসেম্বরের আগেই। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোটামুটি ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষা হয়। অন্য বছরের তুলনায় এবছর ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেকটাই দেরিতে। শিক্ষকরা বলছেন, এরফলে এবার ক্লাসের সময় মিলবে অন্যবারের থেকেও কম। তাই এখন থেকেই দুশ্চিন্তা বাড়ছে তাদের।

শিলিগুড়ি কলেজের (Siliguri College) অধ্যক্ষ সুজিত ঘোষের কথা, ‘আমরা আতঙ্কে আছি। প্রথম সিমেস্টারের জন্য মাসখানেকও ক্লাসের সুযোগ পাওয়া যায় না। আর যাঁরা শেষের দিকে ভর্তি হন তাঁদের ক্লাস চেনার আগেই পরীক্ষায় বসতে হয়। এইভাবে ভালো ফল করা বাস্তবে সম্ভব নয়। আমরা বারবার সমস্যার কথা বিভিন্ন স্তরে আলোচনা করেছি। এর সুষ্ঠু সমাধান হওয়া দরকার।’ এই সমস্যার বড় প্রভাব যে উচ্চশিক্ষায় পড়ছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দীপককুমার রায়। তাঁর বক্তব্য, ‘ছাত্রছাত্রীরা মেরেকেটে ২০ দিন ক্লাস করতে পারবেন। এই সময়ের মধ্যে পাঠক্রম শেষ করার কথা ভাবাও অন্যায়। কিছু না জেনে, না বুঝেই ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় বসছেন। আমরা এক ভয়ংকর সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। উচ্চশিক্ষায় এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এভাবে চললে উত্তরবঙ্গের মতো পিছিয়ে পড়া এলাকায় উচ্চশিক্ষায় অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। কলেজগুলিতে ভর্তি কমছে। আর্থিকভাবে সচ্ছলরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছে। সর্বপরি সঠিক সরকারি পরিকল্পনার অভাবে মেধা অন্যত্র চলে যাচ্ছে।’

শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্নাতক স্তরের সমস্যা আরও গভীরে। ইতিমধ্যেই চার বছরের স্নাতক কোর্স চালু হলেও সপ্তম ও অষ্টম সিমেস্টারের পাঠক্রমের সুস্পষ্ট রূপরেখাই তৈরি হয়নি। বিভিন্ন পাঠক্রমে বহু গলদ থেকে গিয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে স্নাতকোত্তরে ভর্তিতেও শুরু হবে জটিলতা। চার বছরের কোর্স হলেও তিন বছরের ডিগ্রি থাকলেই স্নাতকোত্তরে ভর্তি হওয়া যাবে। ফলে চতুর্থ বছরের দুটি সিমেস্টারের পরীক্ষা তখনও বাকি থাকবে। সেক্ষেত্রে পড়ুয়ারা একইসঙ্গে স্নাতকোত্তরের প্রথম বর্ষের দুটি সিমেস্টার এবং স্নাতক স্তরের চতুর্থ বছরের দুটি সিমেস্টার পড়তে পারবেন কি না, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

চার বছরের স্নাতক কোর্স নিয়ে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই আজ পর্যন্ত বিধি তৈরি করেনি। তাছাড়া, সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা পাশ করলে, পড়ুয়াটি কোন ধরনের চাকরির পরীক্ষার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন হবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনও কথাই শিক্ষা দপ্তর জানায়নি। শিক্ষাবিদ দিলীপকুমার সরকারের মতে, দিশাহীন এই ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ অজানা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে একটা সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিযোগিতায় এবং চাকরির লড়াইয়ে পিছিয়েই যেতে থাকবে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা।’ (চলবে)

Sushmita Ghosh
Sushmita Ghoshhttps://uttarbangasambad.com/
Sushmita Ghosh is working as Sub Editor Since 2018. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad Digital. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.

Share post:

Popular

More like this
Related

Shiv Sena MLA slaps | পচা খাবার পরিবেশনের অভিযোগ, ক্যান্টিন কর্মীকে চড় বিধায়কের

মুম্বই: তাঁকে পচা খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। ডাল থেকে...

Mathabhanga College | বন্ধ ঘরে তরুণের সঙ্গে শিক্ষিকা! পুলিশের হাতে দিল কলেজ কর্তৃপক্ষ

বিশ্বজিৎ সাহা, মাথাভাঙ্গা: বহিরাগত তরুণের সঙ্গে বন্ধ ঘরে পাওয়া...

Buxa | অটোয় চেপে লুকোচুরির যাত্রা বক্সায়

অভিজিৎ ঘোষ, আলিপুরদুয়ার: বর্ষার নিয়ম অনুযায়ী জঙ্গল তো বন্ধ।...

Jalpaiguri | নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুন, ৩ জনকে ফাঁসির সাজা দিল জলপাইগুড়ি পকসো আদালত

সৌরভ দেব, জলপাইগুড়ি: দশম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের...