Tuesday, January 21, 2025
Homeকলামআমরা-ওরা, মাপকাঠি শুধুই আনুগত্য

আমরা-ওরা, মাপকাঠি শুধুই আনুগত্য

 

  • আশিস ঘোষ 

আমরা আর ওরা। সেই কবে থেকে বাঙালি দু’ভাগে ভাগ হয়ে আছে। হয় তুমি আমার দিকে, আমরা। নয়তো আমাদের বিপক্ষে, ওরা। এই হল দু’দিকের ভাগ। গত জমানায় ব্যাপক চালু হয়েছিল এই আমরা-ওরা। যাঁরা দল আর সরকারের দিকে, বেছে বেছে তাঁরা একদিকে। আর যাঁরা উঠতে-বসতে সরকারের নিন্দেমন্দ করেন, তাঁরা অন্যদিকে। তুমি নন্দীগ্রামের মিছিলে হেঁটেছিলে, সরকারি লাইনের বাইরে গিয়ে গল্প, কবিতা, নাটক লিখেছিলে- তুমি ওরা। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের শত্রু, বুর্জোয়া।

আর তুমি যদি সরকারের দিকে থাকো, তুমি আমরা। তোমার জন্য নন্দনের সদর দরজা হাটখোলা। এই যেমন যাঁরা আরজি কর নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরা ওরা। আর দলের, সরকারের হয়ে সেই দুঃসময়ে যাঁরা গলা ফাটিয়েছেন, তাঁরা আমরা। সিধে হিসেব। সোজা ভাগ। সুতরাং তাঁরা সরকারের, সরকারি দলের দাক্ষিণ্য পাবেন। অন্য কিছু বিবেচ্য নয়।

আবার তুমি যদি বৈষম্যের বিরোধিতা করো, যদি ধর্মের নামে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নকে নিন্দা করো, তবে তুমি ওরা। তুমি আরবান নকশাল, টুকরে টুকরে গ্যাং, দেশদ্রোহী, আরও কত কী। আর যদি তুমি হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দ্যাখো, যদি মনে করো সংখ্যালঘুমাত্রই দেশের বিপদ, তবে তুমি আমরা।

বাম আমলে কেন্দ্রের বঞ্চনা থেকে নিকারাগুয়ায় মার্কিনি আগ্রাসন, নয়া শিল্পনীতি থেকে ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি- সবেতেই বামফ্রন্টের তরফে ঘনঘন বিবৃতি জারি হত। জনা ষাটেকের নামে লেখা হত সেই বিবৃতি। তাতে শুরু থেকে শেষ- সব লিস্টে একই নাম। যাঁদের নাম তাঁদের আর জনে জনে বলাকওয়ার দরকার ছিল না। তালিকা একই থাকত। কেবল ওপরের বয়ানটুকু বদলে যেত। বছরের পর বছর। জানাই ছিল, কেউ আপত্তি করবেন না। এটা ছিল আমরা-র পাকা তালিকা।

একেবারে শেষবেলায় ছবিটা পালটে গিয়েছিল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময়। তখন এই তালিকাভুক্তরা সবাই একসুরে বাজছিলেন না। অনেকে শিবির ছেড়েছিলেন। তখন আমরা হয়ে গেল ওরা। চক্রান্তকারী, জনবিরোধী। শ্রেণিশত্রু। সেই কট্টর খাড়াখাড়ি ভাগটা এই আমলে ধীরে ধীরে কমে এসেছিল।

তার একটা বড় কারণ, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই ছিলেন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পাশে। কলকাতার বুকে যে বিশাল অরাজনৈতিক মিছিল হয়েছিল, কে ছিলেন না তাতে। মার্কামারা অনেক কবি, সাহিত্যিক, গায়ক সেসময় ছিলেন খোলাখুলি সরকারবিরোধী। সরকারি পুরস্কারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। নতুন সরকারের আমলে তাঁরা অনেকে নানাভাবে সরকারি কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। পুরস্কারের ক্ষেত্রে আগের বাছবিচার বলতে গেলে তেমন ছিলই না।

মঞ্চ আর টেলিভিশনের অভিনেতারা অনেকেই চলে এসেছেন সামনে। বলতে গেলে ওরা-র পাট একপ্রকার উঠেই গিয়েছে। সরকারি অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন প্রায় সবাই। পুরস্কৃত হয়েছেন অনেকে। তা সত্ত্বেও সরকারি হল পায় না অপছন্দের সিনেমা। তবে এখন আরজি কর নিয়ে তৃণমূলে ঝামেলা বেশ জট পাকিয়েছে। এক দলের স্পষ্টকথা, যাঁরা সরকারকে, দলনেত্রীকে অপমান করেছেন, তাঁদের তৃণমূলের মঞ্চে তোলা চলবে না। এই মতের পক্ষে লোকজন নেহাত কম নয়। দলে নাট্যকার-মন্ত্রী থেকে সাংসদ, অনেকেই এদিকে।

এ নিয়ে ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডেলে লেখালেখিও চলেছে। যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর নামে কুকথা বলেছেন, তাঁদের ডাকা হবে কেন? এ পর্যন্ত ছিল একরকম। এরপর গোল পাকিয়েছেন দলের দুই নম্বর নেতা অভিষেক। তাঁর সোজা কথা, তিনি এই বয়কটের বিরোধী। শিল্পীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। তিনি নিজেও ওই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। এভাবে আন্দোলনে নামার জন্য কাউকে বাদ দেওয়াটা ঠিক নয়।

ব্যাস, শুরু হয়ে গেল কথার লড়াই। বয়কটপন্থীরা নানারকম ব্যাখ্যা দিয়ে বিবাদটা লঘু করার চেষ্টা করলেও এই কথাযুদ্ধ কি বুঝিয়ে দিচ্ছে না যে, আমরা-ওরা মরেনি, মরবে না? বাম আমলে তাদের মঞ্চে যাঁরা আলো করে বসে থাকতেন, তাঁদের কেউ কেউ একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে সামনের সারি আলো করে বসে থাকেন কী করে? ক্যাম্প বদলালে আমরা হয়ে যাবে ওরা?

একজন শিল্পী বা লেখকের একমাত্র পরিচয় তো তাঁর প্রতিভা, তাঁর দক্ষতা। তাঁর রাজনৈতিক মত যাই হোক, তাঁকে সেজন্য বাদ দেওয়া যায় কি? তবে তো সলিল চৌধুরীকে তাঁর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা জানানোর আগে দশবার ভাবতে হবে। মৃণাল সেনের ফিল্ম জায়গা পাবে না চলচ্চিত্র উৎসবে। আসলে মুখে যে যাই বলুন, আসল মাপকাঠিটা হল আনুগত্য। প্রশ্নহীন আনুগত্য। যে কোনও শাসকই তা পছন্দ করে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Lataguri | মানিককে নিয়ে আশঙ্কা ছিল মাধের মনে

0
শুভদীপ শর্মা, লাটাগুড়ি: দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে মূর্তি ইকো কটেজে ৪১০০ টাকার বেতনে দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন মাধে খেড়িয়া। স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে এই...

Domohani | রেল ঐতিহ্যের দোমোহনি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: স্বাধীনতার আগে ১৮৯১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল দোমোহনি (Domohani)। আর তাকে কেন্দ্র করেই জমজমাট...

Ind-Eng T20 series | নেতা গম্ভীরের দরাজ প্রশংসা ম্যাককুলামের

0
সঞ্জীবকুমার দত্ত কলকাতা: চেনা ইডেন গার্ডেন্স। কয়েক বছর পর ফের একদা নিজের ‘দ্বিতীয় হোম’-এ পা রাখা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক, কোচের দায়িত্ব সামলেছেন বেশ...

Accident | স্কুল থেকে ফেরার পথে বেপরোয়া বাইকের ধাক্কা! মৃত্যু আট বছরের পড়ুয়ার

0
শিলিগুড়ি: বাইকের বেপরোয়া গতির শিকার হতে হল এক আট বছরের স্কুল ছাত্রকে। মঙ্গলবার দুপুর দু’টো নাগাদ ঘটনাটি (Accident) ঘটেছে ভোরের আলো থানার (Bhorer Alo...

Malda News | পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রিতে অসম্মতির জেরে অপহরণ! দুষ্কৃতীদের ডেরা থেকে পালিয়ে বাঁচলেন...

0
জসিমুদ্দিন আহম্মদ, মালদা: পৈতৃক সম্পত্তি বেচতে চান না বৃদ্ধ। তাই তাঁর জমি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিতে তাঁকে অপহরণ করল দুষ্কৃতীরা। দলিলে সই করাতে রাতভর নির্মম...

Most Popular