চন্দ্রনারায়ণ সাহা, রায়গঞ্জ: রমজান মাসে ছোট বৌমা কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় বৃদ্ধ জয়নাল ভাবলেন, এ তো আল্লাহর মেহেরবানি। খুশির ইদ আসার আগেই যেন অন্য এক খুশির মাহফিল। আনন্দ আর ধরে রাখতে না পেরে হাসপাতালেই নিজের খুশি অন্য সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন তিনি। ছোট ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের ঘর আলো করে নাতনি এসেছে। এই আনন্দে আজ রোজার শেষে হাসপাতালেই সবার সঙ্গে ইফতার করব।’ যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। বাবার ইচ্ছে পূরণে ছেলে মাসুদও উত্তর দিনাজপুরের (Uttar Dinajpur) রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল চত্বরেই সোমবার বিকেলে আয়োজন করলেন ইফতারের। শুধু রোজাদাররাই নয়, হাসপাতালে আসা অন্য ধর্মের মানুষরাও যোগ দিলেন সেই খুশির ইফতারে। কন্যাসন্তানের আগমনী আনন্দের সঙ্গে এদিন বসন্ত বিকেলে মিশে গেল সম্প্রীতির সুর।
দিনকয়েক আগেই প্রসবযন্ত্রণা ওঠায় রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (Raiganj Medical College & Hospital) ভর্তি করা হয়েছিল ইটাহারের ভাটিনগ্রামের আসমা পারভিনকে। আসমার স্বামী মাসুদ ছোটখাটো ব্যবসা করেন। সঙ্গে জমিতে চাষবাসও চলে। সোমবার আসমা এক কন্যা শিশুর জন্ম দিতেই আনন্দে ডগমগ হয়ে ওঠেন তাঁর শ্বশুর জয়নাল আবেদিন ও শাশুড়ি তাসলেমা বিবি।
পেশায় কৃষক জয়নাল বলেন, ‘ছোট ছেলের বছর তিনেক একটি পুত্রসন্তান আছে। আজ তারই ঘরে এল কন্যা সন্তান। পবিত্র রমজান মাসে কন্যা সন্তানের জন্মকে আমরা ওপরওয়ালার উপহার হিসেবে ভাবছি। আল্লাহর নিয়ামত ছাড়া এ উপহার পাওয়া যায় না। তাই নাতনির মুখ দেখার আনন্দ সমাজের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আজ এখানেই রোজা ভেঙে সবাইকে নিয়ে ইফতার করার আয়োজন করেছি।”
জয়নাল জানেন সমাজে এখনও মেয়েদের নানাভাবে বঞ্চিত হতে হয়। পণের বলি হয়ে প্রাণ হারায় অনেক মেয়ে। তাঁর কথায়, “কন্যারাও যে আমাদের পরিবারে আশীর্বাদ হয়েই আসে, সমাজকে বার্তা দিতেই আজ এই উদ্যোগ নিয়েছি। আমি চাই, আমার নাতনি যেন সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বড় হয়। আজ ইফতারে উপস্থিত সকলের আশীর্বাদ তার আগামী জীবনকে সুস্থ ও সুন্দর করে রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।”
রায়গঞ্জের পকোম্বা গ্রামের বাসিন্দা আসগর আলি এদিন হাসপাতালে এসেছিলেন এক আত্মীয়র চিকিৎসার জন্য। ইফতারে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “এমন অভাবনীয় ইফতারের কথা আগে কখনও শুনিনি। আজ চোখে দেখলাম, অংশও নিলাম। মাঝেমধ্যেই খবরে দেখি কন্যাভ্রুণ হত্যা হচ্ছে। অথচ আজ দেখলাম, পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নেওয়ায় ঠাকুর্দার কী আনন্দ। এমন উদ্যোগ অবশ্যই সমাজ সচেতনতার বার্তা দেবে বলে মনে করি।”
হাসপাতালের ক্যাম্পাসেই জল, খেজুর, ঘুঘনি ও মুড়ি সহযোগে ইফতার করেন প্রায় ২০০ জন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে মিলে এই খুশির মুহূর্ত ভাগ করে নেন। মা আসমার ইচ্ছায় এদিন নতুন কন্যার নামও রাখা হয়েছে – মেহা পারভিন। মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে।
সব দেখেশুনে সমাজকর্মী কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, “জয়নাল সাহেবের এই উদ্যোগ সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ যেভাবে এই আয়োজনে অংশ নিয়েছেন, তা ভবিষ্যতের জন্য আশার বার্তা দেয়। পাশাপাশি কন্যা শিশুর জন্য তিনি যেভাবে আনন্দ উফযাপন করলেন তা-ও সকলের কাছে শিক্ষনীয় হয়ে থাকবে।”