রণজিৎ ঘোষ, শিলিগুড়ি : একখানা হলুদ চিরকুট। তাতে লেখা তিনখানা নাম। দপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্তার ব্যক্তিগত সচিবের (পিএ) জমা করা সেই হলুদ চিরকুটের ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট এজেন্সির নামে টেন্ডার পাশ হচ্ছে। কোন টেন্ডার কে পাবে, কত টাকায় রফা হবে সেই সমস্ত কিছু ঠিক হচ্ছে উত্তরকন্যার ক্যান্টিনে বসে। এই ক্যান্টিন এবং তার ওপরতলার অফিসই মূলত কোটি কোটি টাকা কাটমানি লেনদেনের ঠেক হয়ে উঠেছে। সেখান থেকেই রোটেশনের ভিত্তিতে পেটোয়া ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়।
কাজ পাওয়ার নিরিখে প্রথম সারিতে রয়েছেন রায়গঞ্জের এক ঠিকাদার। অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের এই পুকুরচুরির খবর কলকাতা পর্যন্ত সবাই জানে। কিন্তু কেউই কোনও ব্যবস্থা নেয় না। বরং এই চক্র চালিয়ে যাওয়াতেই মদত দেওয়া হচ্ছে।
বিধানসভায় বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক তথা শিলিগুড়ির বিধায়ক শংকর ঘোষ বলছেন, ‘উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের এই সীমাহীন দুর্নীতির প্রসঙ্গ বিধানসভায় তুলব। পাশাপাশি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটেও (ইডি) দরবার করব।’
অন্য দপ্তরগুলির মতো উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরে কাটমানি, বিল পেতে কমিশন দেওয়ার প্রথা ২০১১ সাল থেকেই রয়েছে। কিন্তু গত দু’আড়াই বছরে এই দপ্তরের দুর্নীতি সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়েছে যে, কোনও কাজের জন্য বরাদ্দ টাকার ৫০ শতাংশের বেশি সেই কাজে ব্যয় করতে পারছেন না ঠিকাদাররা। একাধিক ঠিকাদার বলছেন, ‘কাটমানি দিতে দিতেই ২৫ শতাংশের বেশি চলে যাচ্ছে। তারপর স্থানীয় ক্লাব, নেতা-নেত্রীরা তো রয়েছেন। কোনও কাজ হলে তাঁরাও হাত পেতে বসে যান। দাবি না মানলে পদে পদে বিরক্ত করেন, কাজের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঝামেলা করেন। তাই তাঁদেরও প্যাকেট দিতে হচ্ছে।’ অনেক এজেন্সি আবার ১৫-২০ শতাংশ এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তার বেশি লাভ সরিয়ে রেখে বাকি টাকায় কাজ করছে। কেননা এই দপ্তরের কাজ পাওয়াটা কিছু এজেন্সির কাছে মনোপলি কারবার হয়ে গিয়েছে।
এজেন্সি সূত্রে খবর, আট জেলায় যত কাজ হয় সবগুলিই ২০-২২ জন ঠিকাদার রোটেশনের ভিত্তিতে করছেন। এই পুরো টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন এক শীর্ষস্থানীয় কর্তার ব্যক্তিগত সচিব। ঠিকাদারদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা, কোন কোন কাজ বের হচ্ছে, কত টাকার প্রকল্প, বিটুমেনের রাস্তার বদলে পেভার্স ব্লকের রাস্তা তৈরি, বেশি টাকার কাজে কোন এজেন্সি সবচেয়ে বেশি কমিশন দেবে অর্থাৎ এককথায় উন্নয়নমূলক কাজের ‘টেন্ডার বিক্রির’ দায়িত্ব ওই ব্যক্তিগত সচিবই নিয়ন্ত্রণ করেন। সেই ব্যক্তিগত সচিবের কাছ থেকেই অনলাইনে টেন্ডার আপলোড হওয়ার আগেই হলুদ চিরকুটে শীর্ষস্থানীয় কর্তার কাছে সওদা হওয়া এজেন্সির তালিকা যায়। হলুদ চিরকুটে তিনটি এজেন্সির নাম লেখা থাকে। যে এজেন্সি সব থেকে বেশি কমিশন দিচ্ছে তার নাম সবার উপরে লেখা হয়। এই চিরকুটে সই হয়ে ফেরত আসার পরই টেন্ডার আপলোড হয়। আগে থেকে নির্দিষ্ট হওয়া এজেন্সি ব্যতীত কোনও এজেন্সি টেন্ডারে অংশ নিয়ে ফেললে সেই এজেন্সির কর্তাকে ডেকে রীতিমতো ধমকান শীর্ষস্থানীয় কর্তার ব্যক্তিগত সচিব।
অভিযোগ, উত্তরকন্যার ক্যান্টিনেই এখন ঘুঘুর বাসা বসেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পেটোয়া ঠিকাদারদের আড্ডা জমছে এখানেই। এই ক্যান্টিনের ওপরতলায় একটি ঘরে রীতিমতো কম্পিউটারে কমিশনের হিসাবনিকাশ লেখা হয়।
উত্তরবঙ্গ সংবাদ কাটমানির খবর তুলে ধরতেই হৃৎকম্প শুরু হয়ে গিয়েছে দপ্তরের কর্তাদের। কয়েকটি এজেন্সির কর্তাদের ওপর শুরু হয়েছে বাড়তি ‘নজরদারি’। দপ্তরের মন্ত্রী উদয়ন গুহ অবশ্য, প্রথম দিন থেকেই দাবি করে আসছেন, স্বচ্ছভাবেই কাজ হচ্ছে তাঁর দপ্তরে।