রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

বিজয়ন এখন সিপিএমের ভগবান

শেষ আপডেট:

 

  • আশিস ঘোষ

ব্যক্তি নয়, সমষ্টি, শ্রেণি। সেই কবে থেকে পইপই করে এ কথা বলে আসছেন সিপিএমের বিদগ্ধ নেতারা। এ পার্টিতে ব্যক্তিপুজোর কোনও জায়গা নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম কাকাবাবু মুজফফর আহমেদ। কেবল তাঁরই জন্মদিন পালন করা হয়। বাকি সব যৌথ নেতৃত্ব।

একবার, সে অনেক বছর  আগে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস নিয়ে প্রচারের যুগে সুভাষ চক্রবর্তী ‘নব বাংলার নব রূপকার’ লিখে জ্যোতি বসুর ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়েছিলেন। পার্টিতে তা নিয়ে মৃদু শোরগোল হলেও জ্যোতিবাবু বলেই তা নিয়ে জলঘোলা খুব একটা হয়নি। সেসময় এসব ভাবাই যেত না। পরে অবশ্য জ্যোতিবাবু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি দেওয়া পোস্টার বেশ চোখে পড়ে। অবশ্যই তাঁদের মৃত্যুর পরে।

এই বাজারে তাদের সেদিন আর নেই। তবে বাংলা, ত্রিপুরা খুইয়ে এখন হাতের পাঁচ কেরলেই টিঁকে আছে কাস্তে হাতুড়ি। সেই কেরলে গত শুক্রবার ছিল সেখানকার রাজ্য সরকারি সচিবালয় কর্মচারী সমিতির অনুষ্ঠান। তিরুবনন্তপুরমে। সেখানে ১০০ মহিলা কর্মচারী মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের স্তুতি করে সমবেত সংগীত পরিবেশন করেছেন। গানের ছত্রে ছত্রে ছিল বিজয়ন বন্দনা। গানটি লিখেছেন সমিতির সদস্য পুভাথুর চিত্রসেনন। তাতে বিজয়নকে সাহসী নেতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিজয়ন যে কেবল করোনা বা নিপা অতিমারিকে শেষ করেছেন তা-ই নয়, তিনি ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও রাজ্যকে রক্ষা করেছেন। খতম করেছেন সামন্ততন্ত্রকে। তিনি সিংহের মতোই বলবান। বিশ্বে কমিউনিজমকে রক্ষা করেছেন তিনি।

এতে অবশ্য মোটেই কুণ্ঠিত নন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে এত সমালোচনা করা হয়। আমার প্রশংসা করে কেউ কিছু বললেই দেখছি আপনাদের মাথা ধরে। ২০২২ সালে সিপিএমের তিরুবনন্তপুরম জেলা কনফারেন্সে পিনারাইকে নিয়ে একদল গেয়েছিল ভক্তিগীতি থিরুভাথিরা। নেচেছিলেন ৫০২ মহিলা।

গানে পিনারাইকে বলা হয়েছিল, ‘কারানাভূতম’, মানে যিনি ভুবন সৃষ্টি করেছেন। থিরুভাথিরা গানে পিনারাইকে ভগবানই বলা হয়েছিল তখন। তার এক বছর আগে পিনারাই ফের জিতে এলে তাঁকে খোলাখুলিই ভগবান বলা হয়েছিল পার্টির বক্তৃতা-স্লোগানে। পিনারাইয়ের একটি পূর্ণাবয়ব ফ্লেক্স কাটআউট লাগানো হয়েছিল মালাপ্পুরমের এক বিষ্ণু মন্দিরের ঠিক সামনেই। সেই ফ্লেক্সে লেখা ছিল, ‘তোমরা জানতে চেয়েছিলে ভগবান কে? জনগণ জানিয়েছে, যে আমাদের খাবার দেয় সেই ভগবান।’ একেবারে তলায় পিনারাইয়ের ছবিতে ডাঁর জুতোর তলায় লালরঙে লেখা ছিল, ‘কেরলের ভগবান’।

এ কে গোপালন, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ থেকে ভি অচ্যুতানন্দন কাউকে নিয়েই এমন খোলাখুলি ব্যক্তিপুজোর চল ছিল না কেরলে। এখন পিনারাই শিবিরের অনেক ক্যাডারই প্রকাশ্যেই তাঁকে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করেন। কেউ কিছু বলেন না, বলার উপায়ও নেই। কারণ দলে তাঁর কবজা প্রশ্নাতীত। তবে সবার ক্ষেত্রে একই বিচার নয়। এর আগে কান্নুরের জেলা সম্পাদক পি জয়রাজনের প্রশংসা করে গান বাজানোয় তাঁর দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। যে ফেসবুকে ১৫ মিনিটের এই গান পোস্ট করা হয়েছিল, সেটি বানিয়েছিলেন কান্নুরের কমরেডরা। তা নিয়ে দলের মধ্যে ব্যাপক গোলমাল হয়েছিল। তার জেরে পদ হারাতে হয়েছিল জয়রাজনকে। সেই ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম পালটে করতে হয়েছিল রেড আর্মি।

অন্যদিকে কেরলের কমিউনিস্ট মন্ত্রী বাসবন খোলাখুলি বলছেন, পিনারাই বিজয়ন ভগবানের আশীর্বাদ।  বিজয়ন দেশের বাইরে বেড়াতে গেলেও আরেক মন্ত্রী সাফাই দেন, আরে ভগবানও তো বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে ভিডিওতে প্রশস্তিভরা গানও হয়েছে। কেউ কিছু বলেনি। দলের রাজ্য সম্পাদক এম ভি গোবিন্দন বিজয়নকে তুলনা করেছেন সূর্যের সঙ্গে। বলেছেন, যারাই তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছে তারাই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। এছাড়া ‘অপরাজেয়’, ‘ফিনিক্স পাখি’, ‘একা বেড়ে ওঠা গাছ’-এর মতো নানারকম বিশেষণের ছড়াছড়ি পিনারাইয়ের প্রশস্তি সংগীতে। ‘আগুন থেকে উঠে আসা ঘোড়া, মাটি থেকে বেড়ে ওঠা সূর্য,  মালয়ালিভূমের অধিপতি’-র মতো কোনও স্তুতিই বাদ পড়েনি। নানারকম কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে থাকা পিনারাই যে ইডি, সিবিআইয়ের হাত থেকে তাঁর দৈববলেই বেরিয়ে আসবেন এসব কথাও বলছেন মালয়ালি কমরেডরা। তাঁরা গাইছেন,‘চেম্পাদাক্কু কাভালাল/চেনকাদল পোলোরাল/চেনকোদি কারাথিলেন্থি/কালান্থিন কাভালাল।’ বাংলায় মানেটা দাঁড়ায়, তিনি লাল ফৌজের অভিভাবক/তিনি অসীম রক্তিম সমুদ্রের মতো/হাতে লাল পতাকা নিয়ে কেরলকে পাহারা দিচ্ছেন।

কে বলল, একা মোদিই ভগবান হতে পারেন!

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

রাজনীতির প্রসাদ পান নেতারা, ভাগ জাতিগোষ্ঠীতে

গৌতম সরকার দিঘায় মন্দির গড়ছে তৃণমূল সরকার। জাতের, ধর্মের লড়াইয়ে...

জমি মানেই খাঁটি সোনা, রামরাজ্যে হরির লুট

 আশিস ঘোষ ‘রাম রাজ বৈঠে ত্রিলোকা/ হর্ষিত ভয়ে...

রিজিওনাল স্কুল সার্ভিস কমিশন ফিরুক

মৈনাক কুন্ডা উন্নয়নের এক অমোঘ প্রশ্ন চিরকালীন। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ...

আশ্বাস যেন শিক্ষকদের উপহাস না হয়ে ওঠে!

গৌতম সরকার ধম্মে সইবে না। সইছেও না। শিক্ষকের গায়ে হাতে তাই...