গৌতম সরকার
ভাবছেন বাঁচা গেল। বড় কোনও ইভেন্ট বা উৎসব যেমন হয় আর কী! যাক, নিশ্চিন্ত! কী খাটুনিটাই না গেল। ভোট আমাদের জীবনে এখন মেগা ইভেন্ট। প্রায় তিন মাস ধরে প্রচারের উচ্চগ্রাম, পারস্পরিক নিন্দা, অকথা-কুকথা, অশান্তি-উত্তেজনা, কোথাও আবার হিংসা, গুলি-বোমাবাজি ইত্যাদির খানিক বিরতি। আপাতত চোখ আগামী মঙ্গলবারের দিকে। পথেঘাটে চর্চা, হচ্ছেটা কী! মোদি থাকছেন না যাচ্ছেন! বঙ্গে দিদির দল বেকায়দায় পড়বে না আরও জমি মজবুত করবে!
আলোচনাটা আরও আড়াই দিন চলবে। তারপর যাবতীয় জল্পনার অবসান। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই। তলিয়ে ভাবলে বড় ভয় চেপে ধরবে। হৃৎকম্পও হতে পারে। অন্তত তিনটি আশু বিপদের সম্ভাবনা পুরো মাত্রায়। প্রথম, ভোট পরবর্তী হিংসা। দ্বিতীয়টি প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা। তৃতীয়টি আরও ভয়ংকর। এবারের নির্বাচনে যে মাত্রায় বিদ্বেষের, বিভাজনের, মেরুকরণের বিষ ছড়িয়েছে, তা আগে কখনও হয়নি। এর প্রভাব কী হতে পারে, ভাবতে এখনই বুক কাঁপছে।
বিপদ তিনটি প্রসঙ্গে বিস্তারিত কথার আগে কিছু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। নির্বাচন কমিশনের সূত্রে পাওয়া সেই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা। পরিমাণটা ভাবুন একবার। এই খরচটাই ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ছিল ৩৮৭০ কোটি টাকা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো লাফিয়ে বাড়ছে নির্বাচনি খরচ।
এই টাকার উৎস কিন্তু আমার-আপনার দেওয়া কর। গণতন্ত্রের উৎসব উদযাপনের মতো সাধু কাজে টাকা লাগবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই টাকা খরচের পর শান্তিতে থাকতে পারব না আমি-আপনি? ভোট পরবর্তী হিংসার কথায় আগে আসি। অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় এই অপরাধটিতে সবসময় এগিয়ে থাকে ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’ বাংলা। এই ক্ষেত্রটিতে সার্থক ‘এগিয়ে বাংলা।’
যে দল জিতল, তাদের তখন সীমাহীন দাপট। হাতে মাথা কাটার মানসিকতা নিয়ে জয়ের বিজাতীয় উল্লাস। পেশাদার জল্লাদদের যেমন হয় আর কী! যে দল হারল, তাদের কোণঠাসা করার বেলাগাম প্রয়াস চলে তখন। আগে থেকেই খুঁজে রাখা হয় বিরোধী দলের স্থানীয় স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থক, এমনকি সেই দলের ভোটারদের। নির্বাচন মিটল মানে হেরো দলের লোকদের কপাল পুড়ল। মারধর, সামাজিক বয়কট, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ তো বটেই, খুন করে দিতে হাত কাঁপে না জয়ে উন্মত্ত দলের বাহিনীর।
এ সব যে মনগড়া কাহিনী নয়, বাংলার মানুষ জানে। সর্বশেষ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে তেমন কাহিনীর বাস্তবায়ন দেখা গিয়েছে। শাসক বাহিনীর তাণ্ডবে ভিটেমাটি ছেড়ে এমনকি অসমে পালিয়ে অনেকে জীবন বাঁচিয়েছেন। পরে কেউ নাকে খত দিয়ে, তাণ্ডবের সেনাপতিদের নজরানায় তুষ্ট করে কিংবা শাসকের পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে ‘শান্তি’ কিনেছেন। ভিটেমাটিতে বসবাসের, রোজগার করে পরিবারের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো জোটানোর ‘লাইসেন্স’ পেয়েছেন।
এমন দুর্দিনে ঝােমলা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন হেরো দলের রাজ্য, জেলা স্তরের নেতারা। বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব সারেন তাঁরা। ফলে যত বিপদ, যত আতঙ্ক, সব নীচুতলায়। শুধু সাধারণ সমর্থক নন, পরাজিত দলের স্থানীয় স্তরের নেতাদেরও তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া। নিজেদের বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। ভোটগণনার আড়াই দিন আগে সেই দুশ্চিন্তা আবারও তাঁদের আতঙ্কে রেখেছে।
দ্বিতীয় বিপদ প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতার উৎস অবশ্য ওপরতলায়। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে। খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়ে রেখেছেন, ৪ জুনের পর রাজনৈতিক ভূকম্প হবে ভারতে। এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যে দুর্নীতিগ্রস্তদের পরবর্তী প্রজন্মও একই অন্যায় করার আগে ১০ বার ভাববে। ভোটের মধ্যে সিবিআই-ইডি’র যে তৎপরতা চলছে, শাসক না পালটালে যে তার গতি কয়েকগুণ বাড়বে সন্দেহ নেই। শাসক পালটালে নয়া শাসক যে একই পথে হাঁটবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
মনে করিয়ে দিই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে শুরু করেছেন, বাম জমানার অবসানের পর ‘বদলা নয়, বদল চাই’ স্লোগান তোলাটা ভুল ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দলের চোখে তো তারা ছাড়া ভূ-ভারতে সৎ রাজনৈতিক দল বা নেতা আর কেউ নেই। যদিও তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আর ভয় নেই। বাংলার পোড়খাওয়া নেতা তাপস রায় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। দুর্নীতির অভিযোগে যাঁর বাড়িতে ইডি হানা দিল, তাঁকে কয়েকদিনের মধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় দিল কেন্দ্রের শাসকদল।
অভিযোগটির কী হল, তল্লাশিতে ইডি কী পেল ইত্যাদি ধামাচাপা পড়ে গেল অনন্তকালের জন্য। একইভাবে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে দল ছাড়ায় প্রাক্তন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বন দপ্তরে নিয়োগে দুর্নীতির যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, সেই ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে আসায় তার ভবিষ্যৎ চলে গেল হিমঘরে। ভোটপর্ব মিটলেই জয়ী দলের প্রতিশোধমূলক তৎপরতা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। আরও অনেকের কাছে ইডি, সিবিআইয়ের কিংবা রাজ্য পুলিশ, সিআইডি’র নোটিশ যাবে, তল্লাশি হবে, গ্রেপ্তার, জেলযাত্রা ইত্যাদি চলবে।
যে হারে হুমকি, পালটা আস্ফালন ভোট প্রচারের পর্বে দেখা গেল, তাতে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার এই পরিণাম অবধারিত। এতে অপরাধীদের সঙ্গে কিছু নিরীহের হেনস্তা হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সবশেষে থাকে তৃতীয় বিপদের ভয়াবহতা। সরাসরি হিন্দু-মুসলমান, এমনকি খ্রিস্টান-মুসলমানের বিরোধ উসকে দেওয়ার যে প্রচার চলেছে, তার বিষের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কোনও দলের জেতা বা হারার ওপর আর সেই প্রভাব নির্ভর করে না।
বিষটি ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে। কিছু জায়গায় যে মেরুকরণের ভিত্তিতে ভোট হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যে দলই জিতুক, বিভেদের এই কালি ছড়াতেই থাকবে স্বাভাবিক নিয়মে। যা আগামীদিনে দেশের, সমাজের চরম ক্ষতি করতেই থাকবে। তিনটি বিপদের কোনওটিই গণতন্ত্রসম্মত নয়। বরং গণতন্ত্রের ওপর আঘাত।