বুথফেরত সমীক্ষা করেছে বেশকিছু সংস্থা। কিন্তু মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে ফলাফলের সবক’টি আভাস একমুখী নয়। ফলে সমীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আবার জনমতের স্পষ্ট প্রতিফলন ঘটাতে অক্ষমতাও সামনে আসে। এর আগে জম্মু ও কাশ্মীর এবং হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচনেও তাই ঘটেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে ৪০০ পারের আস্ফালন মুখ থুবড়ে পড়ার পর হরিয়ানা স্বস্তি দিয়েছিল বিজেপিকে।
এখন বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের ফলাফলের সঙ্গে বিজেপির ভবিষ্যৎ জড়িত। গত লোকসভা নির্বাচনে মারাঠাভূমে আশানুরূপ ফল হয়নি বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের। বরং উদ্ধব ঠাকরে ও শারদ পাওয়ারের দল ভাঙানোর খেসারতই দিতে হয়েছিল। একনাথ শিন্ডে ও অজিত পাওয়ারদের দাপটের প্রতিফলন ঘটেনি। এই বিধানসভা নির্বাচনে সেই ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটলে দল ভাঙানিয়াদের নিয়ে জোটের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটতে পারে। বিজেপির ভবিষ্যৎও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। শতবর্ষ উদযাপনরত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের পক্ষেও বিষয়টা স্বস্তিদায়ক হবে না।
মহারাষ্ট্র মুঠোয় ধরে রাখতে সেই কারণে পূর্ণ শক্তিতে নেমেছিল সংঘ পরিবার। লোকসভা নির্বাচনের লজ্জা ঢাকতে ঝাড়খণ্ড পুনরুদ্ধারও ছিল গেরুয়া বাহিনীর পাখির চোখ। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার জাতীয় প্রকল্পে মহারাষ্ট্রে মহিলাদের ভোট নিশ্চিত করার চেষ্টা হয়েছে ঠিকই। তবে শুধু জোট সরকারের উন্নয়ন বা উন্নয়নের আশ্বাসের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি সংঘ পরিবার। মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডে এই শক্তির মূল অস্ত্র হয়ে উঠেছিল হিন্দুত্ব।
ধর্মীয় তাস খেলতে এখন হিন্দুত্বের অন্যতম পোস্টার বয় যোগী আদিত্যনাথ, হিমন্ত বিশ্বশর্মাদের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ নিজেদের কৌশলে তলে তলে সেই তাস খেলেছে। শেষমুহূর্তে হিন্দুদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট একটি ভিডিও ভোটবাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন ভিডিওটি তুলে নিতে নির্দেশ দিয়েছে বটে, কিন্তু ততক্ষণে সেটি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। ভিডিওটিতে ভিনধর্মাবলম্বীরা ঘরবাড়ি পর্যন্ত দখল করে নেবে বলে বার্তা স্পষ্ট ছিল।
ঝাড়খণ্ডে অনুপ্রবেশ, লাভ জিহাদ ইত্যাদি তাসও অবলীলায় খেলা হয়েছে। এইসব প্রচার করার কিছু উপাদান ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রশমিত করার বদলে উসকে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে প্রকাশ্যে। প্রতিবেশী বাংলাদেশ ভিন্ন বয়ানে সেই চেষ্টার গোড়ায় ধোঁয়া দিয়েছে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে সওয়াল করেছেন, সে দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি রাখার যুক্তি নেই। কেননা, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে সন্দেহ নেই। পালটা ন্যারেটিভ তৈরি করার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গিয়েছে সংঘ পরিবার। শেষপর্যন্ত যদি বিজেপি এই দুটি রাজ্যে জয়ের মুখ দেখে, তাহলে তা হবে ধর্মীয় মেরুকরণের জয়। এই মেরুকরণ নিয়ে বিজেপির কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। আজকের ভারতে এই বয়ানের সমর্থক একেবারে কম নয়।
বিরোধী শক্তির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পালটা ন্যারেটিভ তৈরি করতে না পারা। কট্টর হিন্দুত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভোট হারানোর ভয় বিরোধী দলগুলিকে নীতিপঙ্গুত্বে ভুগিয়েছে। সেটাও বিজেপির পথকে প্রশস্ত করেছে। শেষপর্যন্ত বিজেপির সমস্ত কৌশল নিষ্ফল করে ‘ইন্ডিয়া’ দুটি বা অন্তত একটি রাজ্যে যদি ক্ষমতায় আসতে সক্ষমও হয়, তবে তা হবে কানের কাছ দিয়ে।
পরিস্থিতি তেমন হলে শুধু বিরোধী দলগুলির জন্য, ভারতের সংবিধান বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হবে। বাংলাদেশের প্রয়াস দেখিয়ে বিপরীত ধর্মীয়, অথচ একই ধরনের চেষ্টার পালে হাওয়া লাগবে। সেই হাওয়া ঠেকাতে বিরোধীরা নীতিনির্ভর হতে পারেনি। ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের ঐক্যও তত জোরালো করতে পারেনি।