- শুভঙ্কর চক্রবর্তী
সমুদ্রমন্থনে যে অমৃতের হাঁড়ি উঠেছিল তা চেটেপুটে খেয়েছেন দেবতারা। আর মানুষের জন্য রেখেছেন জল। জলই জীবনের অমৃত। প্রথম প্রাণের সৃষ্টি এই জলেই। পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। পাঁচ-পাঁচটি মহাসাগর, বেশ কয়েকটি সাগর-উপসাগর, অগণিত নদ-নদী, খাল-বিলের বিপুল জলরাশি ভাণ্ডার। তা সত্ত্বেও পানীয় জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গিয়েছে।
জলসংকট ভবিষ্যতে যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন দেশের বিদ্বজ্জনেরা। কেন এমন আশঙ্কা তা একটা ছোট্ট উদাহরণই তার আভাস দেবে। বছরখানেক আগে মার্কিন সংস্থা প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০ সাল থেকে পৃথিবীজুড়েই জল সংক্রান্ত সংঘাত বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ এই দশ বছরে জল সংক্রান্ত ১০৬৩টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। জলের জন্য এই সময়ে ৬৭১টি সংঘর্ষ হয়েছে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির ওয়াটার অ্যান্ড ক্লাইমেট ল্যাবরেটরির তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে এশিয়ায় নথিভুক্ত জল সংঘাতের ৪৩ শতাংশ ভারতে হয়েছিল। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশে পানীয় জল নিয়ে সংঘর্ষ বেড়েই চলছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘ক্রাইমস ইন ইন্ডিয়া-২০১৯’-এর রিপোর্টে এনসিআরবি বলেছে, ২০১৯ সালে ভারতের ১১ রাজ্যে জল সম্পর্কিত ৭৯৩ বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে পানীয় জল নিয়ে সংঘর্ষের ছয়টি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
ভাবুন পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে!
এবার আসি উত্তরবঙ্গের কথায়। উত্তরের আট জেলার বহু এলাকাতেই এখনও পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছায়নি। পাহাড় ও দুর্গম বনবস্তি এলাকায় সমস্যা দিন-দিন বাড়ছে। শহর ও গঞ্জ এলাকাগুলিতেও পানীয় জল ক্রমেই মহার্ঘ হচ্ছে। উত্তরের একটা বড় অংশের মানুষ পানীয় জল কিনে খাচ্ছেন। পানীয় জলের জন্য প্রায় প্রতিদিনই উত্তরের কোথাও না কোথাও পথ অবরোধ, পঞ্চায়েত দপ্তরে বিক্ষোভ ইত্যাদি অান্দোলন হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গের অঘোষিত রাজধানী শিলিগুড়ি শহরে পুরনিগম বিষাক্ত পানীয় জল সরবরাহ করায় জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছে। আর শিলিগুড়ির জল কাণ্ডের পর পানীয় জলের বিশুদ্ধতা নিয়ে খোঁজখবর শুরু হতেই একের পর এক ভয়ংকর ঘটনা সামনে আসছে, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে শুদ্ধ পানীয় জলের নামে নাগরিকদের বিশুদ্ধ ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে।
আমরা পানীয় জল হিসাবে কোন জল খাই? ১) পুরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের মাধ্যমে, এককথায় সরকারিভাবে সরবরাহ করা জল। ২) বাজার থেকে স্থানীয় বা বহুজাতিক কোম্পানির কেনা জল (জার, বোতল ইত্যাদি)। ৩) টিউবওয়েল, কুয়ো, নদী, পুকুর, ঝরনা থেকে সরাসরি তোলা অপরিস্রুত জল।
টিউবওয়েল, ঝরনা বা কুয়ো থেকে তোলা অপরিস্রুত জল বিষাক্ত হতে পারে তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সরকারিভাবে সরবরাহ করা বা বাজার থেকে কেনা জল পরিস্রুত না বিষাক্ত তা বোঝার কোনও উপায় নেই। সেই জল আমরা পান করছি শুধু বিশ্বাসের উপর ভর করে। পিএইচই’র জল তো? না না। ওদের জল বিষাক্ত হতেই পারে না- এটাই আমাদের বিশ্বাস। অসুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সেই বিশ্বাস টলবে না। শুধু অসুস্থ হলেই হবে না, যদি ডাক্তারবাবু বলেন যে, জল খাওয়ার জন্যই অসুস্থ হয়েছি তবেই বিশ্বাসে আঘাত আসবে।
যদি শিলিগুড়ির মেয়র না জানাতেন তাহলে কি কেউ বিষাক্ত জলের কথা জানতে পারত? সপ্তাহখানেক ধরে বিষাক্ত জল খেয়েও শিলিগুড়িতে কিন্তু একসঙ্গে বহু মানুষ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েননি। ফলে গৌতম দেব বিষয়টি বেমালুম চেপে গেলেও কিছুই করার ছিল না। এটা একদিক থেকে ভালো যে, পরিণামের কথা চিন্তা না করে তিনি সত্য কথাটি বলে দিয়েছেন। আসলে সয়ে যাওয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। চিকিৎসকদের একাংশও বলছেন, অপরিস্রুত জল পান করতে করতে শরীর সেই জলকে তার মতো মানিয়ে নিচ্ছে। তবে সেটা যে মোটেই ভালো কথা নয় তা জানাতেও ভোলেননি তাঁরা। অনেকেই বলছেন, ‘ধুর ওসব কিচ্ছু না। এই জল খেয়েই তো দিব্যি আছি।’ চিকিৎসকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে বিষাক্ত জল খেয়েও কিছুই হয়নি মনে হলেও ধীরে ধীরে সেই জলের বিষাক্ত পদার্থ ও জীবাণু মানব শরীরে ক্যানসারের মতো নানা প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, সাধু সাবধান।
শিলিগুড়ি ছাড়াও উত্তরের আর এক শহর মালদার একটা অংশে পানীয় জল হিসাবে মহানন্দার জল সরবরাহ করা হয়। সেখানেও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে জল পরিস্রুত হয়। শহরের অন্য অংশে ভূগর্ভস্থ জল তুলে সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তর। কোচবিহার শহরে তোর্ষা, বালুরঘাটে আত্রেয়ী নদীর পরিস্রুত জল শহরবাসীকে খাওয়ানো হয়। কোচবিহারে অবশ্য ভূগর্ভস্থ জল তুলে সেই জল সরবরাহের ব্যবস্থাও আছে।
আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, জলপাইগুড়ি শহরে পানীয় জলের মূল উৎস ভূগর্ভস্থ জল। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের মাধ্যমেই সেই জল বাড়ি বাড়ি পৌঁছায়। উত্তরের ছোট শহরগুলিতেও পানীয় জলের মূল উৎস ওই ভূগর্ভস্থ জলই।
শিলিগুড়ির মেয়র তো বিষাক্ত জলের কথা বলে দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত অন্য কোনও পুরসভার চেয়ারম্যান বা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের কর্তারা তেমন কথা জানাননি। প্রত্যেকেরই দাবি, তাঁদের সরবরাহ করা জল পরিস্রুত। তাতে কোনও বিষাক্ত পদার্থ নেই।
এ তো গেল সরকারি জল সরবরাহকারীদের দাবি। ব্যাঙের ছাতার মতো বিভিন্ন শহর ও গঞ্জে জার ও বোতলবন্দি পানীয় জল দেদারে বিকোচ্ছে। সেইসব জলও পরিস্রুত বলেই দাবি করছেন বেসরকারি পানীয় জল ব্যবসায়ীরা। এই দাবি সত্যি না মিথ্যা সেটা যাচাই করার কোনও শর্টকাট উপায় সাধারণ মানুষের হাতে নেই। বলা ভালো উপায় বের করা হয়নি। হলেই হয়তো জারিজুরি ধরা পড়ে যেত। সংবাদমাধ্যমের দৌলতে বেসরকারি জল ব্যবসায়ীদের অনৈতিক বহু কারবার সামনে এসেছে। কিন্তু সরকারি দপ্তর কী করছে তা রহস্যময়।
শিলিগুড়ি কাণ্ডের পর জলের বায়োলজিকাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) সম্পর্কে আমরা কমবেশি জেনেছি। কিন্তু জলের কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন ভূগর্ভস্থ জলকে পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তখন। ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের সময় মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে অজৈব পদার্থ বা রাসায়নিক তাতে মিশে যায়। সেই রাসায়নিকগুলো জাড়িত হওয়ার জন্য জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন শোষণ করে। তাতেই জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। আর জল হয়ে ওঠে বিষাক্ত।
ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে একেক এলাকার জলের গুণমান একেক রকম। মালদার ভূগর্ভস্থ জল আর শিলিগুড়ির ভূগর্ভস্থ জল এক নয়। মালদার জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাই পাহাড়, জঙ্গল, নদী ঘেরা উত্তরবঙ্গের জন্য একটা ওয়াটার ম্যাপ খুব জরুরি।
পানীয় জলের সমস্ত মান নির্ণয় করা যায় এমন উন্নত প্রযুক্তির ল্যাবরেটরি উত্তরবঙ্গের কোথাওই নেই। মনে রাখা দরকার শুধু বিওডি বা সিওডি ঠিক হলেই হবে না পানীয় জলে ইকোলাই-এর সংখ্যা শূন্য হতে হবে। ফ্লুরাইড, আর্সেনিকও যাতে সঠিক মাত্রার থেকে বেশি না হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। সেই কাজ কিন্তু সঠিকভাবে কোথাওই হচ্ছে না। জলের অপর নাম জীবন। আর সেই জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে সরকারি, বেসরকারি সব সংস্থাই।