শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

পড়ুয়াদের ক্ষতি কতটা, ভুলে থাকি যুদ্ধের আঁচে

শেষ আপডেট:

গৌতম সরকার

ক’দিন ওয়ার্ম আপ চলছিল সেনাবাহিনীর। মহড়া, মোতায়েন, মক ড্রিল…। যুদ্ধের ম-ম ভাব যেন। ওয়ার্ম আপ যেন আমাদেরও। পাকিস্তানকে বেশ দু’ঘা দেওয়া যাবে আনন্দে আমাদের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ কম হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত ভারত বা পাকিস্তান, কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না করুক, যুদ্ধ একরকম বেধেই গিয়েছে। প্রত্যাশা পূরণের আনন্দে তাই দেশজুড়ে উল্লাস। কট্টর মোদি বিরোধীও সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভারতমাতা কি জয়’ পোস্ট লিখছেন সগর্বে।

বামমনস্ক এক শিক্ষক বলছিলেন, যত যাই হোক, পাকিস্তানকে টাইট দেওয়ার এই সুযোগ ছাড়া কি উচিত হবে বলুন! অতঃপর মনস্কামনা পূরণ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের ধাত্রীভূমি, মৌলবাদের আঁতুড় পাকিস্তানের উদ্দেশে সরকারের গা গরম করা বিবৃতিতে আসমুদ্রহিমাচল উত্তেজনার পারদ চড়ছিল ক’দিন ধরে। কেউ কেউ অধৈর্য হচ্ছিলেন, আরে মশাই, ৫৬ ইঞ্চি করছেনটা কী! মুরোদ নেই নাকি! পারলে আমরাই যেন মার্চিং অর্ডার দিই সেনাবাহিনীকে।

প্রত্যাশা পূরণের সেই উত্তেজনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের সকালে ঘুম ভেঙে মনে পড়ে গেল তাঁর অমোঘ বার্তা, ‘নীল আকাশের কোন সুদূরে আছ/ তুমি যেথা দাঁড়ায়ে/ সেথা হতেই শান্তির বাণী দাও দুটি/ হাত বাড়ায়ে…।’ যিনি শিখিয়ে গিয়েছেন, ‘আমাদের আশ্রয়স্থল মানবতা।… দেশপ্রেমকে মানবতার ওপরে জয়লাভ করতে দেব না।’ জঙ্গিদের লেলিয়ে দিয়ে মানবতাকে খুন করেছে পাকিস্তান। তার শাস্তি সেদেশের সরকার, সেনার প্রাপ্য। উগ্রপন্থীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে সেই শাস্তি দিয়েছে ভারত।

অতঃপর ভাবী প্রজন্মের জন্য কী বার্তা? যে প্রজন্মের বড় সমস্যা এখন লেখাপড়া। আমাদের রাজ্যে এখন গরমের ছুটি। যেন অনন্ত ছুটি! কবে স্কুল খুলবে, এতদিন কেউ জানত না। ছুটির দিন মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা ছাত্রদের বলে দিতে পারেননি, কবে আবার স্কুলে আসতে হবে। অলিখিত একলাইনের সরকারি বার্তা আছে… পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ছুটি চলবে। অবশেষে এল পরবর্তী নির্দেশ, জুনের ১ তারিখ পর্যন্ত টানা ছুটি।

দীর্ঘ ছুটি মানে স্কুলে সিলেবাস শেষ না হওয়ার বিপদ। পড়াশোনা এগিয়ে নিতে কতটা সর্বনাশ, জানে পড়ুয়ারাই। ইতিমধ্যে আমরা যেন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা ভুলে গিয়েছি। যুদ্ধের উত্তাপে যেন মুছে যাচ্ছে চাকরি বাতিলে ২৬ হাজারের কান্না, চোখের জল। প্রাইমারির ৩২ হাজারের চাকরি যে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর অনিশ্চয়তার সুতোয় ঝুলছে, তাও গৌণ হয়ে যাচ্ছে।

স্কুলে স্কুলে পড়ানোর শিক্ষক কম, ঘণ্টা বাজানোর শিক্ষাকর্মী নেই ইত্যাদিতে চরম শিক্ষা বিপর্যয়ের সবচেয়ে বেশি খেসারত তো দিতে হচ্ছে ভাবী প্রজন্মকে। যাদের আমরা দেশপ্রেমের শিক্ষা দিয়ে থাকি। যুদ্ধের আবহে যাদের মক ড্রিলে অংশগ্রহণ করানো হচ্ছে কোথাও কোথাও। সাইরেন বাজলে কী করতে হবে, কোথায় লুকোতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ অনির্দিষ্টকালের গরমের ছুটি পড়ুয়াদের অনেক বিড়ম্বনাকে যেন আড়াল করে দিচ্ছে।

স্কুল যবেই খুলুক, সিমেস্টার সিস্টেমে দ্বাদশ শ্রেণির প্রথম পরীক্ষা সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত হয়ে আছে। অথচ ওই ক্লাসের বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ের সরকারি বই এখনও দেওয়া হয়নি পড়ুয়াদের। ইতিমধ্যে সিলেবাস বদলে গিয়েছে। পুরোনো বই পড়ে লাভ নেই। গোটা ছুটিটা ওইসব বই না পড়ে স্কুল খুললে পরীক্ষা দেবে কীভাবে! কে ভাববে এসব? সমাধানের পথ কে দেখাবে? কোথাও আলোচনা নেই।

শিক্ষকসংকট পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। দু’বছর আগে মেখলিগঞ্জ হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ করে দিতে হয়েছে পড়ানোর শিক্ষক না থাকায়। সুনাম থাকলেও একই পরিস্থিতি ইসলামপুর গার্লস হাইস্কুলে। প্রাক্তনীরা কোনওরকমে লেখাপড়াকে টিকিয়ে রেখেছেন। বাংলায় শিক্ষকের অভাব পঠনপাঠনের বড় বাধা। ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল সেই সংকটে নিঃসন্দেহে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

আপাতত সরকারের ভাষায় ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের স্কুলে ফিরিয়ে জোড়াতালি ব্যবস্থা চালু করতে না করতে গরমের ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে। ডিসেম্বরে এই যোগ্যদের মেয়াদ ফুরোলে পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর হবে, ভাবতে ভয় লাগে। তাছাড়া অস্বীকার করা তো যাবে না যে, এই অপমান, অনিশ্চয়তায় শিক্ষকদের মনোবল তলানিতে ঠেকেছে। শিক্ষককুলের সেই বিধ্বস্ত পরিস্থিতিও চাপা পড়ে যাচ্ছে যুদ্ধের উত্তেজনায়। সরকারি কৌশলে, দিশাহীনতায় শিক্ষক আন্দোলন ইতিমধ্যে কার্যত ছত্রভঙ্গ।

শিক্ষকদের যন্ত্রণা, তাঁদের পরিবারের উদ্বেগ ইত্যাদি যেন চাপা পড়ে গেল পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার উল্লাসে। রবীন্দ্রনাথ মানবতার জয়গানের শিক্ষা ভুলে আমরা চলেছি ভিন্ন পথে। অন্যদিকে, যে শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাঁদের প্রতি সমাজের সন্দেহের চোখ প্রভাব ফেলছে পড়ুয়াদের ওপর। এই শিক্ষকদের কাছে শেখার আগ্রহ কতটা থাকবে, সন্দেহ জাগে। শিক্ষা কেলেঙ্কারিতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় যে পড়ুয়াদেরই।

যাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে ব্যস্ত আমরা। অথচ শিক্ষার অভাব যাদের বিশৃঙ্খলার পথে ঠেলে দিতে পারে। উদাহরণ বাংলাদেশ।

আমি তো আছি, ভরসা রাখুন… ইত্যাদি স্তোকবাক্য অনেক শুনেছেন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা। ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকরি ও বেতনের স্বস্তি ছাড়া আর কোনও পদক্ষেপ কিন্তু দেখেননি তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, ‘চিরনূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ।’ ফন্দিফিকির, অসততা সরিয়ে শিক্ষার বাগানে ফুল ফোটাতে না পারলে সেই ডাক কি সার্থক করা যাবে! যুদ্ধের নামে ভুল খবর, ফেক ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে যে পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে শিক্ষার কোন ফুল ফুটবে বলুন তো!

পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের চারপাশে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যে, ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’, তাদের জন্য এই বোধটা তৈরি হওয়া দরকার, ‘শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস…।’ তবে ‘দানবের সাথে সংগ্রামের তরে’ ঘরে ঘরে প্রস্তুতি আছে কি আদৌ!!

Categories
Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

লাঠিচার্জের আগে ভাবুন, কার পাপে তালা ভাঙেন শিক্ষকরা

গৌতম সরকার অন্যায়, অপদার্থতা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা... কোনও শব্দই যেন যথেষ্ট...

পাকিস্তানের স্বর্ণভূমিই মৃত্যু-বিপ্লবের অন্য নাম

রূপায়ণ ভট্টাচার্য একটার পর একটা নোংরা মর্গ ঘুরে সেই বালোচ...

ঘনাদার সঙ্গে পাল্লা দিলেন ব্রজদা

আশিস ঘোষ শুধু মিসাইল, ড্রোনের হিসেবই নয়, একটা যুদ্ধ আমাদের...

সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব জনতা, নেতাদেরও 

দীপককুমার রায় উত্তরবঙ্গ ভারতবর্ষের ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিভিন্ন জাতি, জনজাতির মানুষ...