বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫

পেট্রোলের দাম বৃদ্ধিতে বাঙালির কী

শেষ আপডেট:

 

  • যশোধরা রায়চৌধুরী

পেট্রোলের দামের উথালপাতালের কারণ অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির উচ্চাবচ অবস্থা। বারেবারেই এই মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে, আমাদের গোলার্ধে মাটি ফুঁড়ে আলাদিনের দৈত্যের মতো উঠেছে নানা সমস্যা আর সংকট। একদা, মানে সেই পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের বাঙালির জীবনে, এক পয়সা ট্রামভাড়ার বৃদ্ধি থেকে দশ পয়সা বাসভাড়ার বৃদ্ধি যেভাবে স্পর্শকাতর বিষয় হয়েছিল, সেভাবে কিন্তু গাড়ি চড়ার অভ্যাসও ছিল না আর তা নিয়ে মাথা ঘামানোও ছিল না। ঐতিহাসিকভাবে গাড়ির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। গাড়ি চালিয়ে বাঙালি ইন্টেলেকচুয়াল ঘোরে না, কাজেই পেট্রোলের দাম বাড়লে ইন্টেলেকচুয়ালের কী, যতক্ষণ সরকার লস গিলে নিয়ে ভাড়া অপরিবর্তিত রাখছেন? এ কথা আজকের উবর-ওলা প্রজন্ম ভুলে গিয়েছে, উদারীকরণ পরবর্তী প্রজন্ম ঘরে ঘরে সাজানো খেলনার মতো নানা মডেলের গাড়ির নাম মুখস্থ করে আজ। কিন্তু তবু, পুরোনো কিছু স্মৃতিকে উসকে দিতেই এ লেখা।

আসলে এগারো নম্বর বাস, মানে পয়দলে হাঁটাহাঁটি করা বাঙালির গ্যাস, বদহজম ব্লাড প্রেশারের সমস্যা ছিল না। আমার ঠাকুরদাদা পায়ে হেঁটে গঙ্গাস্নান করে আসতেন রোজ সকালে। ভবানীপুর থেকে শিয়ালদা পায়ে হেঁটে মেরে দেওয়া কোনও ব্যাপার ছিল না। এ প্রজন্মের  প্রস্থানের পর বাসে-ট্রামে চড়া স্বাধীনতা-উত্তর মধ্যবিত্ত এল। কিন্তু তাদের ভেতরেও মোটরগাড়িবিরোধী একটা প্রচ্ছন্ন একপেশে ভাব লালিত হয়েছিল। সত্যি বলতে কি বাসে-ট্রামেও তখন বাদুড়ঝোলা ভিড় শুরু হয়নি।

 নায়ক ছবির সেই সিনটা মনে করে দেখুন। উত্তম কুমারের বামপন্থী বন্ধু প্রেমাংশু বসু তার গাড়িতে চেপে তাকে নিয়ে নিজেদের বন্ধ কারখানার গেট মিটিং এ আনতে চেষ্টা করছে, নায়ক অরিন্দমের হিম্মতে কুলোচ্ছে না রাজনৈতিক অবস্থান নিতে, সে পলায়নপর। এই ইমেজ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে বহুকাল। গাড়ি চালাতে পারে হিরো, কর্পোরেট, প্রাইভেট সেক্টর, আর সরকারি সেক্টরের অতি উঁচু পদের কেউ… যাদের পা মাটিতে পড়ে না, পৃথিবীর ধুলোর সন্তান নয় যারা। ফলত, এই লোকগুলো আপামর ভারতবাসীর কাছে এক হিসেবে ব্রাত্য। গাড়ি যাদের আছে, ৬০-৭০-৮০ দশকের বাঙালির কাছে তারা স্নব ও পশ।

পঞ্চাশের যুগান্তকারী কৃত্তিবাসী কবিদের কথাই ধরা যাক। যাঁদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিয়মিত ট্যাক্সি চাপার (মাতাল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যরাতের কলকাতায় বিখ্যাত ঠ্যালাগাড়ি চাপারও) নানা অ্যানেকডোটে ভরভরাট আমাদের যৌথ স্মৃতি। আবার ওই দলের মধ্যেই শরৎকুমার ছিলেন কর্পোরেট চাকুরে। ফলত তাঁর একটি মরিস মাইনর গাড়ি ছিল, তিনি সেটাতে চাপিয়ে বিজয়া মুখোপাধ্যায়কে (বিয়ের আগে দাশগুপ্ত) এদিক-ওদিক নিয়ে যেতেন সেই কাহিনী বিজয়াদির সাক্ষাৎকারে ছাপা হয়েছে। গাড়িতে করে সন্ধে অবধি বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরে, তার বাড়ির নিয়ম মেনে ন’টায় নামিয়ে দিয়ে, তারপর তিনি কোথায় যাবেন, তা নিয়ে খেদ করছেন, কারণ ততক্ষণ তাঁর বিখ্যাত অন্য কবি বন্ধুরা চলে গিয়েছেন খালাসিটোলায় মদ্যপান করতে। একইসঙ্গে বিজয়া বলেছেন, শরৎদা যে একটু বেশি সু-উপায়ী ছিলেন, তাই কৃত্তিবাসের দলের সবার ফাইফরমাশ খাটাও ছিল তাঁর একটা কাজ।

পিকনিক-এ রমাপদ চৌধুরী জনাচারেক বন্ধুর মধ্যে একজনকে দেখিয়েছিলেন যে গাড়ির মালিক, তার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। গাড়ির সুবিধা, বা আজকের ভাষায় গাড়ি আছে যাঁদের তাঁদের ‘র‍্যালা’ যতই থেকে থাকুক, জনমানসে কোথাও তাঁরা একটু যেন আলাদা, আর তাই কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে গাড়ি থাকলে তিনি অন্যদের কাছে সামান্য অপরাধীই হয়ে থাকতেন বোধ করি।

অথচ, সহ অভিনেতাদের স্মৃতিচারণের পাতায় মঞ্জু দে-র মতো অভিনেত্রীকেও জানছি নিজের গাড়িটি নিজে চালিয়ে আসতেন, হাতের আঙুলে গাড়ির চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আত্মকথনে পেয়েছি গাড়ির গল্প। যৌথ পরিবারের ছেলে, খাওয়াপরা নিয়ে চিন্তা ছিল না, সরকারি চাকরি পেয়েই গাড়ি কিনলেন আর ড্রাইভ করে এদিক-ওদিক যেতেন। প্রাইভেট সেক্টরে বা কর্পোরেটে চাকরি করা সে সময়ের অনেক মানুষই গাড়ি কিনতেন ও নিজে চালাতেন। ব্যাপারটার মধ্যে একটা প্রতিস্পর্ধাও ছিল। শোফার ড্রিভেন প্রাচীন গাড়ি আর বাড়ির বিশাল গাড়িবারান্দা যদি হয়ে থাকে প্রাচীন অভিজাত জমিদার প্যাটার্নের বড়লোকি কারবার, তবে ষাট-সত্তর দশকের নব্য বাবুদের ‘হাতে রথে’ থাকাটা ছিল একটা নতুন জমানা, যখন আপনা হাত জগন্নাথ, পুরুষকার বলে টাকা করছেন বাঙালিরা, বাবা-মামা-কাকার টাকায় ফুটানি মারছেন না।

নিজের গাড়ি নিজে চালানো, বা নিজে গাড়ির বনেট খুলে সারিয়ে ফেলতে পারার মধ্যে যে প্রবল আত্মবিশ্বাস ও ডিগনিটি অফ লেবারের ব্যাপার আছে, তারই আঁচ পাচ্ছি ১৯৬৩-র ছায়াছবি ‘দেয়া নেয়া’-র ধুতি-ফতুয়াধারী উত্তমকুমার বনাম স্নবিশ অভিজাত পাহাড়ি সান্যালের ভাগ্নী তনুজার টক্করে। যেখানে উত্তম খটখট করে গাড়ি সারাতে শুরু করলে তনুজার প্রশ্ন, ও সব ভেঙে ফেলবে না তো মামা? গাড়ির পার্টস চেনে তো? আর উত্তরে উত্তমের স্পর্ধিত উত্তর ‘যারা গাড়ি চাপে, তারাই কি চেনে?’

এইসবের সঙ্গেই জুড়ে যায় আমার শৈশব স্মৃতি, মধ্যপ্রাচ্যের ওপেক গোষ্ঠী আর আমার মাত্র আট-ন’ বছর অবধি ‘গাড়ি চাপা’র প্রিভিলেজপ্রাপ্তির ইতিহাস। যে গল্প লিখলেই ‘ঐ দ্যাখ নিজেদের পুকুরভরা মাছ আর বাগানভরা ফলের গপ্পো শোনানো বাঙাল’ জাতীয় উপহাস জুটবে আমার কপালে। যাইহোক, তাল ঠুকে গল্পটি বলেই ফেলি।

আমার বাবা ছিলেন রাবার ও রং উৎপাদক বিদেশি কম্পানিতে কেমিস্ট। এবং তিনি একটি গাড়িও কিনেছিলেন। মা-বাবার বিবাহ হয় ১৯৫৯ সালে, মনে হয় তারই আগে পরে ওই ছোট্ট মতো গাড়িটি আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। হ্যাঁ সদস্যই, বাড়ির জিনিসপত্রের সঙ্গে কীরকমভাবে যেন সম্পর্ক তৈরি করতেন আমার মা। সম্ভবত বাবাও করতেন। বাবার কেনা গাড়ি স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড, সেটির নাম ওঁরা দিলেন বড়ছেলে। সেই কারণেই ফ্রিজ মেজো, রেকর্ড প্লেয়ার সেজো, আর রেডিও কনিষ্ঠ।

১৯৬৬ সালে বাবার অকালমৃত্যু। বাবার প্রিয় গাড়ি নাকি বাবার দেহ শ্মশানে পুড়তে যাবার পর, নিজে নিজে চিৎকার করে উঠেছিল। আমরাও, অনেক পরে দেখেছি, সেই স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডের আর্ত কান্না। দেখেছি হর্ন নিজে নিজে বেজে উঠতে অনেকবার। তবে মা ওই বেজে ওঠাটাকে প্রাণবন্ত আদরের যন্ত্রের কান্না হিসেবেই নিয়েছিলেন। বাবার দেহ যখন গিলে নিচ্ছে আগুন, তখন শ্মশানের বাইরে রাখা গাড়ি ওভাবে হর্ন বাজিয়ে আর্তনাদ করেই চলেছে। যতক্ষণ না কেউ গিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে হর্ন টিপে তা বন্ধ করে। আমাদের শৈশবের অনেক গল্পের একটি। এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে কালী ব্যানার্জি অভিনীত ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত অযান্ত্রিক ছবির কথা। সুবোধ ঘোষের অনিবার্য আশ্চর্য গল্পে আধারিত। গাড়িরও প্রাণ আছে!

বাবার প্রিয় গাড়িটি বাবার স্মৃতি হয়ে ছিল। স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডের পেছনে কোনও দরজা নেই। সামনের দরজা খুলে সিট ভাঁজ করে পেছনে ঢুকতে হয় আমাদের। ১৯৭৩ সালে ওপেক দেশগুলি একজোট হয়ে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি করার পর মা আর গাড়ি চালানো অ্যাফোর্ড করতে পারেননি, মামাকে কিছু অর্থমূল্যের পরিবর্তে দিয়ে দিলেন একপ্রকার। আন্তর্জাতিক একটা ঘটনার সঙ্গে আমাদের ছোট্টবেলার অনেক স্মৃতি গিল্টি করা ফ্রেমে বাঁধানো হয়ে গেল।

ইশকুলে সাদা গাড়ি নিজে চালিয়ে মায়ের আমাদের দিতে যাওয়াটা ইতিহাস হয়ে গেল চিরতরে। মা-বাবার গাড়ি চালিয়েই আমাদের নিয়ে যেতেন এখানে-ওখানে। বেড়াতে, মেলায়, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, রবীন্দ্রসদনে, অ্যাকাডেমিতে ছবির প্রদর্শনী দেখাতে।

সাদা শাড়ি পরিহিতা পয়ঁত্রিশ-চল্লিশের চশমা পরা বিধবা মা, মুখে চাপানো কঠোরতার মুখোশ। আমাদের এঁকেবেঁকে নদীর মতো চলা গলি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরুচ্ছেন, আর গলির কোলেকাঁখে থাকা বস্তিগুলোর থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে আসছে কালোকোলো বাচ্চারা, এক জোট হয়ে চিৎকার করে সুর করে গাইছে, লড়কি গাআআআআআড়ি চলা রহি হ্যায়!

কী বিস্ময়। মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। তারপরেই এল এই দামবৃদ্ধির বিভীষিকা। মা ভাবলেন, নাহ। গাড়ি মেইনটেন করা আর নয়। কিন্তু বাবার কেনা গাড়ি, এত মায়ার গাড়ি, ছেড়ে দিতে খুব কষ্ট হয়েছিল মায়ের। রাস্তায় অনুরূপ অন্য হর্নের শব্দ শুনে চমকে উঠতেন মা, যেমন সন্তানের গলার স্বরে উৎকর্ণ হয়ে যায় মায়ের প্রাণ।

তারপর আমার ক্লাস থ্রি-ফোর থেকে আমি ইশকুল বাসে চড়তে লাগলাম। সেইসব ইশকুল বাস, ফার্স্ট ট্রিপ সেকেন্ড ট্রিপের গল্প জীবনে ঢুকে গেল। এল মুড়ির টিনের মধ্যে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাড়ি ফেরা, সঠিক স্টপে নেমে হেঁটে একা বাড়ি আসা। ইশকুল বাস আমাকে স্বাধীনতা দিল, দিল অনেক অভিজ্ঞতা। সেকেন্ড ট্রিপের জন্য আমরা ফিস্টি প্ল্যান করতাম। কেউ আনত মুড়ি, কেউ চানাচুর, কেউ আচার। দিনশেষে আচারের তেলে অঙ্ক খাতা মাখামাখি।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

কানকাটা ভ্যানগগ ও শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউট

শেখর বসু ফুলারটন হলের আচ্ছন্নতা কাটতে একটু দেরি হয়েছিল। আস্তে...

পর্যটন ছাড়াও উত্তরবঙ্গের ভাঁড়ার সমৃদ্ধ

তিতীর্ষা জোয়ারদার গরম বা শীতের ছুটি মানেই, ভ্রমণের হাতছানি।...

নিজস্ব ছটায় শেষ দিন পর্যন্ত স্বতন্ত্র

  আশিস ঘোষ কমরেড স্তালিন কি হাসেন? সোভিয়েত জমানায়...

মিষ্টি হোক বা তেতো দিনটা চকোলেটের 

অরিন্দম ঘোষ আমাদের ছোটবেলায় বয়স্ক মানুষরা কেউ কেউ গাল টিপে...