উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সম্প্রতি আমরা পেরিয়ে এলাম বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এবছরের থিম ছিল, ‘প্রতিটি মিনিট মূল্যবান’। স্ট্রোকে (Stroke) আক্রান্ত হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। মস্তিষ্কের ক্ষতির আশঙ্কা কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে। দেরি মানেই ক্ষতি। লিখেছেন শিলিগুড়ির নেওটিয়া গেটওয়েল মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটােলর স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ তন্ময় পাল।
৪৮ বছর বয়সি অমিত সেন অফিসে মিটিং চলাকালীন হঠাৎ একপাশের হাত-পায়ে দুর্বলতা অনুভব করেন। মুখ বেঁকে যায়, আর কথা জড়িয়ে যায়। সহকর্মীরা প্রথমে ভাবেন, হয়তো রক্তচাপ কমে গিয়েছে। কিন্তু অফিসের একজন তরুণ BE FAST ফর্মুলা মনে রেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকেন এবং অমিতকে ৩০ মিনিটের মধ্যে শহরের স্ট্রোক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে সিটি স্ক্যানে দেখা যায়, ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়েছে। চিকিৎসকরা দ্রুত থ্রম্বোলাইটিক ইনজেকশন দেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অমিতের কথা ও চলাফেরার ক্ষমতা অনেকটাই ফিরে আসে। পরের সপ্তাহে তিনি নিজের পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যান। ডাক্তারের কথায়, ‘যদি আর আধ ঘণ্টা দেরি হত, তাঁর অর্ধেক দেহ পক্ষাঘাতে অচল হয়ে যেত।’ অর্থাৎ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেইসঙ্গে লক্ষণ চেনাও জরুরি।
কিন্তু স্ট্রোক এত আতঙ্কের কেন? স্ট্রোক বা ‘ব্রেন অ্যাটাক’ হল এক জরুরি চিকিৎসাজনিত অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় বা কোনও রক্তনািল ফেটে রক্তক্ষরণ হয়। তখন মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন ও পুষ্টি না পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যেতে শুরু করে। প্রতি মিনিটে প্রায় ১৯ লক্ষ মস্তিষ্কের কোষ নষ্ট হয়, যদি চিকিৎসা না নেওয়া হয়। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘টাইম ইজ ব্রেন’ অর্থাৎ দেরি মানেই ক্ষতি।
স্ট্রোক প্রধানত দুই প্রকারের
ইস্কেমিক স্ট্রোক – মস্তিষ্কের কোনও রক্তনািলতে রক্ত জমাট বাঁধলে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এটি সব স্ট্রোকের প্রায় ৮৫ শতাংশ ঘটে।
হেমারেজিক স্ট্রোক – মস্তিষ্কের রক্তনািল ফেটে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। এটি তুলনামূলকভাবে কম হলেও প্রায়ই জীবনহানির ঝুঁকি বেশি থাকে।
লক্ষণ চেনার উপায়
এক্ষেত্রে মনে রাখুন আধুনিক ফর্মুলা BE FAST
B – Balance (ভারসাম্য): হঠাৎ ভারসাম্য হারানো, হাঁটতে কষ্ট বা মাথা ঘোরা
E – Eyes (চোখ): এক বা দুই চোখে দৃষ্টি ঝাপসা বা কমে যাওয়া
F – Face (মুখ): মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া বা হাসতে না পারা
A – Arm (হাত): এক হাত বা পা দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া
S – Speech (বাক): কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট উচ্চারণ বা কথা বলতে না পারা
T – Time (সময়): এক মুহূর্তও দেরি নয় – অবিলম্বে নিকটস্থ ‘স্ট্রোক রেডি’ হাসপাতালে নিয়ে
যান
BE FAST মানে BE SMART দ্রুত চিনুন, দ্রুত পদক্ষেপ করুন।
রোগ নির্ণয়ের উপায়
কোন ধরনের স্ট্রোক হয়েছে তা শুধুমাত্র সিটিস্ক্যান বা এমআরআইয়ের মাধ্যমে জানা যায়। তাই নিজে অনুমান না করে অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
চিকিৎসার জন্য কতটা সময় হাতে থাকে
যদি ইস্কেমিক স্ট্রোক হয়, তাহলে প্রথম ৪.৫ ঘণ্টার মধ্যে রক্ত জমাট গলানোর ইনজেকশন (থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি) দিলে মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায়। আর বড় ধমনীর ব্লক হলে মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমি নামের আধুনিক পদ্ধতিতে জমাট বাঁধা রক্ত টেনে বের করা যায়। এটি ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর।
তবে সবই নির্ভর করছে আপনি কত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারছেন তার ওপর। দেরি মানেই ক্ষতি। তাই দেরি নয়, অ্যাকশন নিন।
কারা বেশি ঝুঁকিতে
যাঁেদর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস বা রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রয়েছে
যাঁরা কম চলাফেরা করেন
যাঁরা ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান করেন
যাঁরা স্থূলতায় ভোগেন বা যাঁরা ব্যায়াম করেন না
যাঁদের হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত
যাঁরা অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও নিদ্রাহীনতায় ভোগেন
যাঁদের বয়স ৫৫ বছরের বেশি বা যদি পরিবারের কারও আগে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে
প্রতিরোধের উপায়
রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরল নিয়মিত পরীক্ষা করুন
ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করুন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন বা হাঁটুন
ফল, শাকসবজি ও কম লবণযুক্ত খাবার খান
পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখুন
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর
স্ট্রোক হলে কী করবেন
- রোগীকে শুইয়ে দিন, মাথা সামান্য উঁচু রাখুন
- নিজে গাড়ি না চালিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকুন
- হাসপাতালে পৌঁছানোর সময় স্ট্রোকের লক্ষণ শুরু হওয়ার সময়টা উল্লেখ করুন, চিকিৎসার সিদ্ধান্তে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
স্ট্রোক কোনও ‘বয়স্কদের রোগ’ নয়। ব্যস্ত জীবন, অনিদ্রা ও মানসিক চাপে আজকাল তরুণদের মধ্যেও স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। তাই নিজে জানুন, অন্যকেও শেখান। কারণ, স্ট্রোকে প্রতিটি মিনিট মানে জীবনের দাম। আর অমিতের গল্প আমাদের শেখায়, BE FAST মানে বাঁচার শেষ সুযোগটুকু কাজে লাগানো।

