- অনিশ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বাভাবিকভাবেই আরজি করের নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিটা মেডিকেল কলেজেই একটা ছাপ ফেলেছে। একটি অন্যায়, একটি অত্যাচারের কোনও বিহিত পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যি সত্যিই আমরা সেই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে ‘স্বাধীনতা’ একটা ‘রঙিন’ রাজতন্ত্রর কফিনবন্দি রংচটা গণতন্ত্রের পোশাক পরানো শীতল মৃতদেহ মাত্র।
একটি হোটেলে ‘ওয়ান নাইট স্টে’ করে সকালে উঠে যদি আমি দেখি যে আমার ট্রলি ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছি না, তাহলে নিশ্চিতভাবে সেই দায় হোটেলের মালিকপক্ষকেই সর্বপ্রথম নিতে হবে। কারণ ন্যূনতম নিরাপত্তা ও সুরক্ষা তারা দিতে বাধ্য। ঠিক তেমনই সরকারি পরিসরের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে একটা অন্যায়, অত্যাচার হলে আমরা তো সরকার তথা প্রশাসনকেই প্রশ্ন করব।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিটা মেডিকেল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘পক্ষ’ বেছে নেওয়ার নিঃশব্দ লড়াই। লড়াইটা একজনের সঙ্গে আরেকজনের নয়। লড়াইটা এক ছাত্রের নিজের ‘সুবিধা’ পাওয়ার মানসিকতার সঙ্গে ডাক্তার হতে চাওয়া একটা বিবেকের লড়াই। এক পক্ষ বিচার চায়, কিন্তু তারা জানে না সেই বিচার পাওয়ার রাস্তাটা কী। সবথেকে বড় কথা, তারা সেটা জানতেও চায় না। কিন্তু তারা ‘বিচার’ চায়। অন্য পক্ষ বিচার চাওয়ার পাশাপাশি প্রতিটা কলেজে উক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ঘটনার অন্তরালে থাকা আনুমানিক একটা একনায়কতন্ত্রের সীমাহীন ক্ষমতার বিনাশ চায় যার প্রতিটা মেডিকেল কলেজেই কমবেশি বীজ রোপিত আছে।
বহুকাল ধরেই আমরা জেনে আসছি যে ‘কলেজ’ মানেই একটা ছাত্র সংগঠন, তাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে বা পোশাকের অন্তরালে কমবেশি ‘রঙিন রাজনীতি’র জন্ম হয়। একজন ডাক্তারি ছাত্রের রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠা তো কোনও অপরাধের বা উচ্ছন্নে যাওয়ার বিষয় নয় বরং ভবিষ্যতের দিশারি হিসেবে সমাজের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে আলাপচারিতা সেরে রাখা ভালো। কিন্তু মেডিকেল কলেজগুলোতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে প্রধানত যখন ছাত্র রাজনীতি কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে।
এভাবে রাজনীতির শীর্ষে থাকা ছাত্রগোষ্ঠী একটা সীমাহীন ‘ক্ষমতা’র অধিকারী বলে নিজেকে ভাবতে শুরু করছে। আর এই ‘ক্ষমতা’ শব্দটার একটাই দোষ, বয়স বাড়লে সীমা ভুলে যায়। এভাবেই হাজার হাজার নিট পাশ করে আসা মেধা সহজলভ্য সুবিধার জাঁতাকলে পা দিয়ে একরকম বাধ্য হয়েই জ্ঞানপাপীর মতো বিসর্জন দিতে থাকছে প্রতিভা, স্বপ্ন, অঙ্গীকার, মনুষ্যত্ব, সম্মান ও পরিচয়। এভাবেই শাসকদলের মদতে প্রতি মেডিকেল কলেজে গড়ে ওঠে ‘থ্রেট কালচার’ আর এভাবেই শাসকদলের আধিপত্য আরও সুদৃঢ় হয় ছাত্রদের হাত ধরে। এটা তো আজকের গল্প না। রং বদলায় আর সময় বদলায়। গল্প এক।
হস্টেলের ছাদ থেকে জল পড়ছে কিংবা লাইব্রেরির অমুক বইগুলো পাওয়া যাচ্ছে না, কিংবা সিমেস্টার পরীক্ষা পুজোর ছুটির পরে নিলে ভালো হয়- এই ছোট্ট ছোট্ট দাবিগুলো তুলে ধরতে বা কলেজের কালচারাল ফেস্ট অথবা ফ্রেশার্স অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে একটা ঐক্য প্রয়োজন আছে অবশ্যই, কিন্তু সেই সংঘবদ্ধতা কলেজের চৌকাঠ অতিক্রম করে ক্ষমতার পরিসীমা ভুলে গিয়ে সীমাহীন রঙিন একনায়কতন্ত্রের পরিবেশ তৈরি করলে মেডিকেল কলেজের পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। ‘পরিসীমা’ ‘পরিসর’ ও ‘উদ্দেশ্য’ অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার। তাহলেই প্রতিটা মেডিকেল কলেজে সুস্থ স্বাভাবিক ভয়হীন পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হবে।
(লেখক এমবিবিএস ছাত্র। কোচবিহার মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ মেডিকেল কলেজ)