বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

সকলকেই চাকরি করতে হবে কে বলল?

শেষ আপডেট:

শিমূল সরকার

দেখো বেশি উড়ো না! মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার আগে থেকেই কানের কাছে গুরুজনদের এই মন্ত্র বাজত। সদ্য গোঁফ গজানো উঠতি বয়সের পড়ুয়ারা এই সব উপদেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিত। কেউ যেত মামার বাড়ির আম গাছে বাঁদরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আম খেতে। কেউ যেত বোঁচকা বেঁধে ঠাকুমার সঙ্গে বৃন্দাবনে। যারা একটু লায়েক, তারা ওপাড়ার চুমকিকে নিয়ে ধাঁ। তারপরে ঢি-ঢি।

এসব চার দশক আগের গল্প। এখন হাতে স্মার্টফোন থাকলে রিল দেখবে বা তৈরি করবে। কে যেন মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর থেকে কামাই হয়। গ্রামের বহুজন এই সময়ে জমিতে বাবা-দাদার সঙ্গে হাত লাগাবে। ডুয়ার্সে বর্ষা আগে নামে। হাতির উৎপাত না থাকলে ভুট্টা চাষ হচ্ছে। কোম্পানি থেকে গাড়ি আসে ভুট্টা কিনতে। অনেকে আবার চা পাতা কেনাবেচায় নেমে পড়ে।

গ্রামে এই দৃশ্য হলেও শহরে কিন্তু ছবিটা ভিন্ন। আগ মার্কা পড়ুয়ারা শিলিগুড়ি, মালদা বা কলকাতায় আত্মীয়ের বাড়ি খুঁজে পেতে হাজির হয় ভালো স্কুল বা কলেজের খোঁজে। অনেকে আগে থেকেই পরের ক্লাসের বই জোগাড় করে পড়তে বসে। টিউশনও চালু রাখে। মাধ্যমিক পুকুর হলে উচ্চমাধ্যমিক বর্ষার তিস্তা, কলেজ – সাগর। সময় বেশ কম। বিপুল সিলেবাস সম্পূর্ণ করা এক চ্যালেঞ্জ।

সকলের অত রেস্ত নেই। তারা ঘরেই মোবাইলে দেখে কোথায় পরের ধাপে পড়াশোনা করবে। এটা এক শ্রেণির পড়ুয়ার প্রচেষ্টা হলে, বেশ কিছুজন এই সুযোগে কম্পিউটারে কাজ শিখে নেয়। তিন মাসের কোর্সে কাজ চালানো গোছের ওয়ার্ড বা এক্সেলের কাজ। কোচবিহার, মালদা বা আলিপুরদুয়ারে এই প্রযুক্তি শিক্ষার সুযোগ আছে।

কিন্তু কালচিনি বা মাদারিহাটে? সেখানে ট্রেনিংয়ের সুযোগ বেশ সীমিত। অভিভাবকদের মধ্যেও প্রয়োজনীয়তার অভাব প্রকট। প্রাইভেটে খরচ করে কম্পিউটার শিক্ষা দিয়ে লাভ কী? ওই তো অমুকের ছেলে কম্পিউটর শিখে বসে আছে। কম্পিউটার শিক্ষার সুবিধা নিয়ে ধারণা বড্ড হালকা।

বহু ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, এখনও বুঝতে পারছে না যে, ভাবী কালে হাতে লেখার কাজ প্রায় উঠে যাবে। পেশায় কম্পিউটার জানা আবশ্যক শর্ত। আরেক দলের কাছে প্রশিক্ষণের জন্য পকেটের খরচ একটা সমস্যা। মোবাইলে টাইপ অনেকে জানে। কিন্তু মোবাইল থেকে মেল পাঠানো বা ল্যাপটপের কাজে বিশেষ গুরুত্ব অজানা।

তারা মাধ্যমিক অবধি পড়েছে, এটা অনেক অভিভাবকের কাছে বড় বিষয়। তারপরে পেশা কী হবে? চৌপথিতে চায়ের দোকানে সকলে চুপ করে গেলেন। অথচ চায়ের ব্যবসা বা পর্যটনে অনলাইনের গুরুত্ব চরমে। ডুয়ার্সের হোটেল, রিসর্টে অনলাইনে বুকিং করিয়ে দু’পয়সা ডুয়ার্সের খুব কম জন পায়। যখন মোবাইলে বুকিং ছিল না, তারা রেলে, প্লেন বা বাসের টিকিটের ব্যবসাতেও তেমন বাজার ধরতে পারেনি। সাফারি বা ভ্রমণের পর গাড়ির ব্যবসাও বেশ অপেশাদারভাবে চলে।

অর্থাৎ পর্যটন ও চা মূল আয়ের পথ হলেও ডুয়ার্সের সকলে সেই পেশায় নাম লেখাতে পারে না। ফলে বাইরে যেতে হচ্ছে কাজের জন্য এবং সামান্য বেতনে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ডুয়ার্সে বিভিন্ন জাতি ও জনজাতির বাস। তাদের জীবন দর্শন ও চাকরির বিযয়ে মানসিকতা ভিন্ন। সকলকেই চাকরি করতে হবে কে বলল? এমন কথাও শুনতে হল। আগের প্রজন্মের খুব কমজন ভাবী, পেশাদার জগৎ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।

(লেখক পুলিশ অফিসার। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন উত্তরবঙ্গে)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পুরুলিয়া টু আলিপুরদুয়ার: মানুষ ও প্রকৃতি  

  আশুতোষ বিশ্বাস কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে উত্তরবঙ্গের...

চম্পাই সোরেন ও তাঁর নয়া আন্দোলন

কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য হ্যাঁ! এবার আদিবাসী নববর্ষে ঝাড়খণ্ডের কোলহান অঞ্চলে...

জার্মানিতে শুধু ছিল না দাউদের ইছামতী 

আলপনা ঘোষ নির্বাসিত বাংলাদেশি কবি, বন্ধু দাউদ হায়দারের বার্লিনে প্রয়াণের...

বনের বাইরে, মানুষের মাঝে কেন বন্যপ্রাণী

বিমল দেবনাথ একদিন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে ছিলাম শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস...