বিমল দেবনাথ
একদিন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে ছিলাম শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসের উলটো দিকে পাকা নালার পাশে। একটা দাঁড়াশ সাপ বেরিয়ে মানুষের পায়ের ফাঁকে ফাঁকে দক্ষিণে চলে গেল। কেউ দেখল না।
হল্লা করলে হুড়োহুড়িতে জখম হত মানুষ। মারা যেতে পারত সাপটা। অধৈর্য ও অজ্ঞ মানুষের জন্য বন্যপ্রাণ ও মানুষের মধ্যে সংঘাত হয়। কিন্তু সাপটা কেন এল জনবহুল এলাকায়? ইকোলজির ভাষায় কারণ হতে পারে ‘নিস’। ‘নিস’-এর যথার্থ বাংলা তর্জমা করা কঠিন। বন্যপ্রাণীদের বন থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে আছে হ্যাবিট্যাট, নিস, হোমরেঞ্জ ও ইকোলজির গূঢ় তত্ত্ব। ইকোলজি, ইকোসিস্টেম এখন আর অবোধ্য নয়। হ্যাবিট্যাট হল কোনও প্রাণীর আবাসস্থল বা ঠিকানা। হোমরেঞ্জ বলতে বোঝায় আবাসস্থলের চৌহদ্দি। জিনগত বৈশিষ্ট্য ও যাপনের প্রয়োজনে প্রাণীদের আবাসস্থলের চৌহদ্দি ছোট-বড় হয়। বাস্তুতন্ত্রে ‘নিস’ অতীব সূক্ষ্ম বিষয়।
ধরা যাক শিলিগুড়ির মতো একটা বন লাগোয়া শহরে হঠাৎ শঙ্খচূড় সাপের উপদ্রব বেড়ে গেল। পিছনে থাকতে পারে শঙ্খচূড় সাপের ‘নিস’-এর হেরফের। শঙ্খচূড় শুধু সাপ খায়। বনে সাপের সংখ্যা কমে গেলে শঙ্খচূড়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। বিজিতরা বাঁচার জন্য ছোটে এদিক-ওদিক। কে মরতে চায় সুন্দর ভুবনে? ঢুকছে শহর, গ্রামগঞ্জের বাড়িতে। আর একটা হতে পারে শহরে বাড়বাড়ন্ত জঞ্জাল, আবর্জনার জন্য বেড়ে গিয়েছে ইঁদুরের সংখ্যা। গন্ধ পেয়ে বনের সর্পকুল আস্তানা গেড়েছে শহরে। সাপের খোঁজে শঙ্খচূড় ঢুকছে শহরে। এভাবেই গ্রাম বা শহরের খুব কাছাকাছি চলে আসছে হাতি, বাইসন, লেপার্ড বা ভালুক। ক’দিন আগে কী হইচই হয়ে গেল একটি হাতির উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢুকে পড়া নিয়ে।
একটা বনে নানা ধরনের বন্যপ্রাণী বসবাস করতে পারে। বাসস্থান এক হলেও প্রত্যেক প্রজাতির ‘নিস’ আলাদা। তৃণভোজী, মাংসাশীদের খাদ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাখিরা পোকা ও গাছের ফল খায়। কেউ বাচ্চা প্রসব করে, কেউ ডিম পাড়ে। কেউ ডিম পাড়ে গাছের কোটরে, কেউ মাটিতে। প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যেক প্রজাতির সম্পর্ক ভিন্ন, পেশা আলাদা। বাসস্থান একটা প্রজাতির ঠিকানা হলে, নিস হল তার পেশা। একটা আবাসস্থলে একই নিস প্রজাতির প্রাণী বেশি সংখ্যায় থাকলে প্রতিযোগিতা বা অন্তর্দ্বন্দ্ব বেশি হয়। বন্যপ্রাণীরা সন্ধান করতে থাকে নতুন বাসযোগ্য বনভূমির। আবাসস্থল সুঠাম থাকলে প্রাণী হোমরেঞ্জের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। মানুষের মতো প্রতিটা প্রাণী নিজের হোমরেঞ্জকে সুরক্ষা দিতে চেষ্টা করে। যার যত বড় হোমরেঞ্জ তার তত বেশি সমস্যা। সব থেকে বেশি সমস্যা পাখিদের। পাখিদের বলা হয় বনের স্বাস্থ্য-সূচক। যত ভালো বন তত বেশি পাখি।
বর্তমানে স্থলজ বন্যপ্রাণীদের মধ্যে ইউরেশিয়ান লিংক্স-এর হোমরেঞ্জ সর্ববৃহৎ। এটা একটা মাঝারি আকারের বন্য বিড়াল। মর্দা বিড়ালের হোমরেঞ্জ প্রায় ২৬০০ বর্গ কিলোমিটার, মহিলার ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরবঙ্গের হাতিদের হোমরেঞ্জ কম নয়। মাদি হাতিরা দল নিয়ে প্রায় ৫৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখলে রাখে। মর্দা হাতিরা দখলে রাখে প্রায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরবঙ্গে হাতির মুক্তাঞ্চল ছিল প্রায় ৩০০০ বর্গ কিমি বন। বর্তমানে খণ্ডিত বনগুলোর মোট এলাকা প্রায় ১৯০০ বর্গ কিমি। বাদবাকি বিখণ্ডিত বনের মাঝে চা বাগান, কৃষিজমি ও বসতি।
উত্তরবঙ্গে চা বাগান স্থাপনের আগে এই এলাকা ছিল অখণ্ড বনভূমি। চা বাগান স্থাপনের পরে গড়ে ওঠে নতুন নতুন বসতি। পতিত জমি যা ছিল হাতিদের উঠোন সেগুলো হয়ে গিয়েছে আবাদি জমি। উন্নয়ন হাতিদের পথ টুকরো টুকরো করে দিলেও সেসব থেকে যায় তাদের স্মৃতিতে। বংশের পর বংশ সেই স্মৃতি ধরে হাতিরা হোমরেঞ্জের মধ্যে হাঁটে। এই পথকে বলা হয় ‘করিডর’। উত্তরবঙ্গে হাতিদের মোট করিডর ছিল ৫৯টা। ৪৭টা করিডরের মালিক চা বাগান ও রায়ত। ২৬টা করিডরে বসবাস করে মানুষ। করিডরের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার। মানুষ বসবাস করে প্রায় ৫৮ কিলোমিটারের ওপর এবং প্রায় ৭ কিলোমিটারের ওপরে আছে মিলিটারি ক্যাম্প।
করিডরগুলো বাস্তুতন্ত্র অনুসারে স্বীকৃত হলেও, নেই কোনও আইনি বৈধতা। হাতির রাস্তার মালিক হাতি নয়। স্বাভাবিকভাবে করিডর ব্যবস্থাপনার ওপরে বন দপ্তরের কোনও আইনি অধিকার নেই। জমির মালিকের ইচ্ছায় করিডরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন বসতি, ঘরবাড়ি, উঁচু বাঁধ, রাস্তা ইত্যাদি। মানুষের জন্য ফোর লেন, সিক্স লেন সড়ক হচ্ছে, ব্রডগেজ রেললাইন বসছে কিন্তু ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ অ্যানিমাল’- হাতির করিডরের আইনি বৈধতার দাবি শোনা যায় না।
আইনি বৈধতা না থাকলে, শুধু মাত্র বাস্তুতান্ত্রিকভাবে করিডর চিহ্নিত করে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত কমানো যাবে না। হাঁটতে গিয়ে হাতি মরছে রেল ইঞ্জিনের ধাক্কা খেয়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ও বিষ খেয়ে। হাতির মুখোমুখি হয়ে মানুষ মরছে নিজের ঘরে, রাস্তায়। মৃত্যুর কারণ শুধু উন্নয়ন নয়, উন্নয়নকামীদের সদিচ্ছার অভাব। মানুষ এখনও বোঝাপড়ার মাধ্যমে সহাবস্থানে সচেতন হয়ে ওঠেনি। একটা দাঁড়াশ সাপ শত শত মানুষের পায়ের চাপ থেকে বেঁচে যেতে পারে কিন্তু একটা মানুষ বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি হলে নিজের জীবন বিপন্ন করে তোলে নিজের ভুলে। বন্যপ্রাণীরা প্রকৃতির সুশৃঙ্খল সন্তান। হোমরেঞ্জ ছেড়ে বাইরে যায় না। মানুষই তাদের বাসভূমি দখল করে বসে আছে।
এটা বোঝার জন্য ইতিহাসবিদ হতে হয় না। নিজের এলাকার অতীত খুঁজলেই বোঝা যায়। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর…’ আমরা পারিনি। বরং গুরুত্ব কমানো হয়েছে বনের। বন্ধ হয়েছে বনে ঢোকার প্রবেশমূল্য। উঠে গিয়েছে স্থানীয় মানুষের হস্তশিল্প গ্রহণ ও লোকসংস্কৃতি উপভোগের বাধ্যতা। কাজ হারিয়ে দরিদ্র মানুষ আবার সরাসরি নির্ভর হচ্ছে বনজের ওপর। নষ্ট হচ্ছে বনের বাস্তুতন্ত্র। উত্ত্যক্ত বন্যপ্রাণী চলে আসছে লোকালয়ে।
সামঞ্জস্যহীন উন্নয়নও সীমিত করছে বন্যপ্রাণীদের হোমরেঞ্জ, হ্যাবিট্যাট। নষ্ট হচ্ছে নিস, বাস্তুতন্ত্র। উন্নয়নের জন্য প্রকৃতির যে ক্ষতি হয় সেটার কিছুটা পূরণ করার কথা বলা থাকে প্রকল্পে। ক্ষতিপূরণের কাজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বন্যপ্রাণীর কথা ভেবে প্রয়োগ হচ্ছে কি না, সেটা কতটা খুঁটিয়ে দেখা হয় জানে না আমজনতা। নিকোবরে যে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কাজ চলছে তার জন্য গ্যালাথিয়া জাতীয় উদ্যানের একটা অংশের তকমা ছিনিয়ে নিয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ কাটা হবে। ক্ষতিপূরণ হিসাবে গাছ লাগানো হবে হরিয়ানাতে! রামের ক্ষতিপূরণ পাবে শ্যাম। কী করা যাবে! ‘জায়েন্ট লেদারব্যাক টার্টল’, ‘নিকোবর মেগাপড’-এর মতো অনেক বন্যপ্রাণী তো মানুষের ভাষায় দাবি জানাতে পারে না। শুধু নিকোবর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্প নয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রায় সব প্রকল্পের পেছনে একই ঘটনা।
উত্তরবঙ্গে চা বাগান নিয়েও চলছে আজব প্রকল্প। ইকোট্যুরিজমের নামে ভেসে আসছে ‘রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসার কথা। চা বাগানের ৩০ শতাংশ জমি হস্তান্তর করার আগে ভাবা হচ্ছে কি হাতির করিডরের বিষয়? করিডর নষ্ট হলে হাতিরা নতুন নতুন করিডর বের করে নেবে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মচারীর অভাবে বনভূমি, বন ও বন্যপ্রাণকে সঠিক সুরক্ষা দিতে পারছে না বন দপ্তর। এই সবকিছুর মধ্যে আছে ছোট-বড় সব বন্যপ্রাণীর নিজ ভূমিতে পরবাসের যন্ত্রণার কারণ। বন্যপ্রাণীরা আছে নিজের জায়গায়, আমরাই ওদের জায়গা দখল করে আছি। কথাটা উপলব্ধি করে বন্যপ্রাণীদের প্রতি সহিষ্ণু হলে মঙ্গল সবার।
(লেখক প্রাক্তন বনকর্তা। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)