পার্থ চৌধুরী
বাংলা ভাষার জন্য আত্মবলিদানে’র সূত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে, এ গর্ব আপামর বাঙালির। এক্ষেত্রে কাঁটাতারের বেড়া কখনোই অন্তরায় হয়নি সংগত কারণেই। দিনটিকে স্মরণ করে দুই বাংলাতেই আমরা সাড়ম্বরে উদযাপনে মেতে আছি বহু বছর ধরে। এ এক অনন্য নজির পৃথিবীর বুকে। ভাষার লড়াই যে একটা দেশকে স্বাধীন করতে পারে, এমনটা দুনিয়ার আর কেউ ভাবতে পেরেছিল?
এই দিনটি আরও মহিমান্বিত হতে পারত, কিন্তু হয়নি আত্মবিস্মৃত এপার বাংলার বাঙালির অনবধানতায়। আমরা সেভাবে গুরুত্বই দিলাম না ‘উনিশে মে’-কে। যদি দিতাম, তাহলে এই দিনটির প্রতি যেমন আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধা প্রকাশ পেত, তেমনই অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারির ভিন্ন বৈশিষ্ট্যটিও সাধারণের আলোচনায় স্থান পেত।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর। বিধানসভার অধিবেশন। অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা একমাত্র অহমিয়াকেই সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির প্রস্তাব আনলেন। বাংলা কিন্তু তখন অসমের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। করিমগঞ্জের বিধায়ক নরেন্দ্রমোহন দাস তীব্র আপত্তি জানালেন প্রস্তাবের বিপক্ষে। কংগ্রেস সরকার আমল দিল না সেই আপত্তির। ২৪ অক্টোবর প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল।
এই ঘটনায় গর্জে উঠলেন অসমের বাঙালিরা। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হল। ১৪ এপ্রিল শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে পালিত হল ‘সংকল্প দিবস’। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা ফুটছেন তখন। তাঁরা এপ্রিল মাসে প্রায় দশদিন ধরে উপত্যকায় প্রচার চালান পদযাত্রা করে। এই যাত্রায় তাঁরা অতিক্রম করে প্রায় ২০০ মাইল পথ। এ যেন আর এক লংমার্চ।
পরিষদের আহ্বায়ক রথীন সেন ঘোষণা করেন, ‘যদি ১৩ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা না হয়, তাহলে ১৯ মে থেকে চলবে টানা হরতাল। বাঙালি বোঝাবে তাঁরা ভাষার জন্য কী করতে পারে।’
অসম সরকার চুপ করে বসে রইল না। নামল অাসাম রাইফেলস, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট এবং স্থানীয় পুলিশ।শিলচরে চলল রুটমার্চ। ১৮ মে আন্দোলনের তিন নেতা রথীন সেন, বিধুভূষণ চৌধুরী এবং নলিনী দাসকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। ১৯ মে ১৯৬১ ঘটল সেই বৈপ্লবিক ঘটনা।
সেদিন সকাল থেকে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে শুরু হল হরতাল। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ পালন চলছিল। দুপুরে উপস্থিত হলেন অাসাম রাইফেলসের জওয়ানরা। বেলা আড়াইটে নাগাদ আন্দোলনকারী বাঙালিদের ওপর লাঠিচার্জ, বেয়নেট চার্জ শুরু করে এই প্যারামিলিটারি বাহিনী। জবাবে ফুঁসে ওঠেন বাঙালিরা। এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ যায় ৯ জন আন্দোলনকারীর। ৩ জন আহত হন। পরদিন তাঁদের মধ্যে ২ জনও মারা যান। শহিদ হন মোট ১১ জন ভাষা শহিদ।
পরদিন ২০ মে মরদেহ সহ শোক মিছিল করে পথে নামে মানুষ। ফলশ্রুতিতে সরকার বাধ্য হয়েছিল বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিতে। আমাদের পূর্বসূরিদের ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে আমরা যথার্থ শ্রদ্ধা জানাই কি? কতজন বাঙালি জানে এই ঐতিহাসিক ঘটনা? আমাদের এত কুণ্ঠা কেন? পশ্চিমবাংলার সর্বত্র এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয় না। একুশের গর্ভজাত উনিশকে আর কতকাল ব্রাত্য করে রাখব আমরা?