রন্তিদেব সেনগুপ্ত
গত সপ্তাহে উত্তরবঙ্গ সংবাদের প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে শিহরিত এবং বিস্মিত হওয়ার মতো একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। ঘটনাটি তৃতীয় দফার ভোটের। ভোটগ্রহণের দিন মালদা জেলার কালিয়াচক ১ নম্বর ব্লকের সিলামপুর ৩ নম্বর বুথে এই বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে। ওই বুথে ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর অন্তত দুজন অভিযোগ করেছেন, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) যে বোতামই টেপা যাচ্ছে, তাতে ভোট চলে যাচ্ছে পদ্ম প্রতীকে।
অভিযোগটি মারাত্মক। অভিযোগ পাওয়ার পরে ইভিএমটি বদলে দেওয়া হয়েছে। এটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বলে নির্বাচন কমিশন বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দিতে চেয়েছে। কমিশন নিষ্পত্তি করতে চাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা পাঁচ পাবলিক, এত হালকাভাবে বিষয়টি নিতে পারছি না। আমাদের ভোট বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এই ঘটনাটি জানার পরে আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
গত সপ্তাহে এই কলামে লিখেছিলাম, নির্বাচন কমিশন নিজেই নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। ভোটপর্ব চলাকালীন নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে এ রকম আরেকটি লেখা লিখতে না হলে খুশি হতাম। বুঝতাম, নির্বাচন কমিশন নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছে। কিন্তু খুশি হওয়ার জো নেই। গত এক সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন এমন একটিও পদক্ষেপ করতে পারেনি বা বলা ভালো করেনি, যেটি আমাদের মনে কমিশন সম্পর্কে আস্থার জন্ম দেবে। ফলে ভোটের আলোচনায় আবার নির্বাচন কমিশনকে টেনে আনতে হচ্ছে।
নির্বাচনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের। ভোটের নোটিফিকেশন থেকে শুরু করে গণনাপর্ব অবধি নির্বাচন কমিশনই প্রথম এবং শেষ কথা বলার অধিকারী। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনও ভুল পদক্ষেপ, ভুল সিদ্ধান্ত, পক্ষপাতিত্ব বা অস্বাভাবিক সন্দেহজনক আচরণ নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে মানুষকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দেয়।
যে ঘটনাটি নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতেই ফিরে আসা যাক। যে ইভিএম ঘিরে সেদিনের ওই অভিযোগ উঠেছিল, সেটিকে সঙ্গে সঙ্গে বদলে দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? বোধহয় না। ওই অভিযোগ ওঠার আগে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের ভোট সঠিক জায়গায় পড়েছিল কি? কে বলবে? যদি তাঁদের ভোট বেহাত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার কী হবে?
মনে রাখা দরকার, অধিকাংশ ভোটার ভোট দেওয়ার পর ভিভিপ্যাটে দেখেন না ভোটটি সঠিক জায়গায় পড়ল কি না। বেশিরভাগ ভোটারই এ বিষয়ে অজ্ঞ। নির্বাচন কমিশনও বিষয়টি সম্পর্কে ভোটারদের কখনও সেভাবে সচেতন করেনি। ফলে এ প্রশ্নও জাগছে যে, ওই বুথটি ছাড়া অন্য কোথাও এরকম ভোট চুরি হয়নি, তার নিশ্চয়তা কোথায়? শুধু বোতাম টিপলেই বিজেপির ঝুড়িতে ভোট পড়ছে বলে বলছি না। এরকমভাবে ভোট যদি তৃণমূল, কংগ্রেস বা সিপিএমের ঝুলিতে পড়ে থাকে, তাহলে সেটাও ক্ষমাহীন অপরাধ।
এবার ভোটপর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই ইভিএম নিয়ে নানাবিধ অভিযোগ উঠছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, ইভিএম সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। ইভিএমে জালিয়াতি করা যায়। কালিয়াচকের ওই বুথের ঘটনাটি এইসব অভিযোগকে মান্যতা দিচ্ছে। ইভিএম নিয়ে আগের নির্বাচনগুলিতে এত অভিযোগ ওঠেনি। ইভিএম নিয়ে এত সংশয়ও গাঢ় হয়ে ওঠেনি কখনও। এই সংশয় এবং সন্দেহের কারণে বিভিন্ন মহল প্রত্যেকটি ইভিএমের সঙ্গে সংযুক্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গণনার দাবি তুলছে। দাবি উঠছে, আবার ব্যালট প্রথার ভোটে ফিরে যাওয়ার। দুটি দাবিই নির্বাচন কমিশন খারিজ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, এতে অনেক সময় বেশি লাগবে।
কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ এবং সুষ্ঠু রাখা। নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মনে যাতে কোনওরকম সন্দেহের উদ্রেক না হয়, তা দেখা। নির্বাচন কমিশনকে কেউ সাত তাড়াতাড়ি ফল প্রকাশ করার জন্য মাথার দিব্যি দেয়নি। অতীতে ব্যালটে ভোটগ্রহণকালে ফল প্রকাশে সময় লাগত। তখন কেউ প্রশ্ন তোলেনি। নির্বাচনকে ঘিরে এত যখন সন্দেহ এবং সংশয়, তখন একটু সময় নিয়ে প্রতিটি ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট মিলিয়ে ভোটগণনায় এত আপত্তি কেন কমিশনের? সেটা করলে তো অন্তত সন্দেহের অবকাশ থাকে না। নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনটা বেশি জরুরি- সাত তাড়াতাড়ি ফল প্রকাশ না ভোটদাতাদের সংশয় দূর করে নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে সুষ্ঠু প্রমাণ করা? উত্তরটা জানতে ইচ্ছে করে।
সন্দেহ ঘনীভূত হয় আরও কিছু কারণে। কমিশনের হেপাজত থেকে ১৯ লক্ষ ইভিএম হাপিস হয়ে যাওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, এই ১৯ লক্ষ ইভিএম গেল কোথায়? এ নিয়ে তদন্ত হয়েছে কি? যে দেশে মুরগি চুরি গেলেও সিবিআই তদন্ত চাওয়া হয়, সেখানে ১৯ লক্ষ ইভিএম চুরি গেলেও কমিশন সিবিআই তদন্ত চায় না কেন? রহস্য সবেতেই।
আগের সপ্তাহে লিখেছিলাম, প্রতিটি কেন্দ্রে মোট ভোটার, প্রদত্ত বৈধ ভোট, কত ভোট বাতিল ইত্যাদি হিসাব নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে না। কনডাক্ট অফ ইলেকশন রুলস অনুযায়ী ফর্ম ১৭সি (পার্ট ১)-এ ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরই সব বুথের প্রিসাইডিং অফিসাররা পোলিং এজেন্টদের সেই হিসাব জানিয়ে থাকেন। এই হিসাব চেয়ে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজন অতি সম্প্রতি চিঠি লিখলেও কমিশনের ভ্রূক্ষেপ নেই। সব মিলিয়েই তাই পরিস্থিতি যথেষ্ট সন্দেহজনক।
জানি না, পরের সপ্তাহেও নির্বাচন কমিশন নিয়ে একই কথা লিখতে হবে কি না। যদি না লিখতে হয়, তাহলে বুঝব, কমিশনের দু’কান এখনও কাটা যায়নি। আর যদি লিখতে হয়? তাহলে ধরে নিতে হবে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।