প্রেমের সপ্তাহে যেন হিংসার উদযাপন। ক’দিন ধরে ট্রেনে ট্রেনে হামলার ভিডিও ভাইরাল। মহাকুম্ভগামী জনস্রোত আছড়ে পড়ছে স্টেশনে স্টেশনে। ভিড় ট্রেনে উঠতে না পেরে তাণ্ডব যেন ফ্যাশন হয়ে গিয়েছে। যত দোষ যেন ট্রেনে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের। কোথাও বাতানুকূল কামরার জানলা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কোথাও দরজা দিয়ে বাঁশ, লাঠি ঢুকিয়ে যাত্রীদের নির্যাতনের ছবি সমাজমাধ্যমে ভরে আছে।
অশান্তির মূলে কিন্তু তীর্থযাত্রীরাই! কুম্ভে যাচ্ছেন গঙ্গায় ডুব দিয়ে পাপক্ষালন করতে। কোটি কোটি মানুষ একই উদ্দেশ্যে প্রয়াগরাজমুখী। এমন যাত্রায় পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা রাখার শিক্ষা দেয় ধর্ম। একই গুরুর শিষ্যদের যেমন প্রীতির সম্পর্ক থাকার কথা, একই ধর্মাবলম্বীদের তেমনই সহাবস্থান কাম্য। বদলে শুধু নিজের স্বার্থে অন্ধ হয়ে একই ধর্মের মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করা শুধু নয়, মারধর, হয়রানির চরম করা হচ্ছে।
চৈতন্যদেবের দেশে শিক্ষা কিন্তু ‘মেরেছে কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না!’ গুলিবিদ্ধ হয়ে যে দেশে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি তাঁর আততায়ীকে ক্ষমা করার বার্তা দিয়েছিলেন। প্রতিহিংসা নয়, ‘হে রাম’ ধ্বনিতে শান্তির শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন অন্তিম মুহূর্তেও। সেখানে ভিন্ন দুই ধর্মের বৈরিতা যেমন ঘোর বাস্তব, তেমন একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেও পারস্পরিক হিংসার ছোঁয়া মানবজীবনকে অস্থির করে তুলছে।
প্রতিবেশী বাংলাদেশে ভিনধর্মের সঙ্গে যেমন, তেমনই এক ধর্মে স্বার্থান্বেষীদের ধ্বংসলীলা দেখা যাচ্ছে। প্রেমের সপ্তাহ শুরুর আগের দিন যাঁরা ঢাকার ধানমন্ডিতে মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভেঙে দিলেন, অগ্নিসংযোগ করলেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় স্বজন। মুজিবুর ধর্মের ভেদ করেননি বটে, কিন্তু নিজ ধর্মকে অস্বীকারও তো করেননি। ফলে তিনি বিধর্মী ছিলেন বলা যায় না। এখন আবার টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবুরের সমাধিতে হামলার প্রস্তুতি চলছে। যাঁরা সেই ছক কষছেন, তাঁরাও মুজিবের ধর্মীয় স্বজন।
কুম্ভগামী জনতার হিংসা দেখে চুপ করে আছে রেল প্রশাসন, সরকার। লাগামছাড়া তাণ্ডব দেখে বাংলাদেশেও নীরব পুলিশ, সেনাবাহিনী। সরকারের ইঙ্গিত ছাড়া যে এই নীরবতা সম্ভব নয়, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ বা গোয়েন্দা হতে হয় না। রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনরা নানা কারণে হিংসায় প্রশ্রয় শুধু নয়, মদত দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় প্রতিপক্ষকে ‘সবক’ শেখাতে সেই মদত যে লাগামহীন হয়ে যায়, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
মদত, প্রশ্রয় পেতে পেতে হিংসা একসময় মানুষের রক্ত-মজ্জায় স্থান পেয়ে যায়। যে কারণে তৈরি হয় অসহিষ্ণুতা। যা মানুষকে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটলে মানুষ তখন অশান্ত হয়ে ওঠে। তার ফলশ্রুতি তাণ্ডব, ধ্বংসযজ্ঞ। ভিন্নধর্মের প্রতি তৈরি করা আক্রোশ থেকে যে অসহনশীলতার জন্ম হয়, তা তখন আছড়ে পড়ে নিজ ধর্মের অনুসারীদের ওপরই।
কুম্ভের পথে কিংবা বাংলাদেশে চলতি যা যা ঘটছে, তা সেই সৃষ্ট অসহনশীলতার পরিণাম। বোতল থেকে দৈত্যকে ছেড়ে দিলে তাকে আর বাগে না আনতে পারার নীতিগল্প বাস্তব হয়ে উঠেছে। অন্যের প্রতি লেলিয়ে দেওয়ার যে শিক্ষা ক্ষমতাসীনরা দিয়ে থাকে, তার বিষফল এখন চারদিকে। হিংসার দৈত্যকে ফের বোতলবন্দি করা অসম্ভব বুঝে শাসক এখন তাই চুপ, নির্বিকার। ভারতে, বাংলাদেশেও।
এই পরিস্থিতি কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেল এই প্রেমের সপ্তাহে। ইংরেজিতে ভ্যালেন্টাইন্স উইক নামে যাকে নিয়ে এত মাতামাতি, প্রশ্ন থাকল, প্রেম কি শুধু নরনারীর? প্রতিবেশী, ধর্মীয় সতীর্থের প্রতি ভালোবাসা নয়? তা যদি না হয়, তাহলে কীসের এত মানবপ্রেমের বড়াই! সৌভ্রাতৃত্ব, সহাবস্থানের ঢাকঢোল পেটানো তো তাহলে অর্থহীন। শাসক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় স্বার্থের কবলে পড়ে আমরা কি এক প্রেমহীন জগতের দিকে এগিয়ে চলেছি?