সঞ্জীব দত্ত, কলকাতা: স্বপ্ন দেখলে বড় করে দেখো। কখনও হাল ছেড়ো না। ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। কথাগুলি বলা যতটা সহজ, করে দেখানো ততটাই কঠিন। গত কয়েক বছরে ক্রিকেট কেরিয়ারের একের পর এক সিঁড়ি চড়তে চড়তে সেটাই প্রমাণ করে দেখাচ্ছেন যশস্বী জয়সওয়াল।
মাত্র ৯ বছর বয়সে ছোট্ট ক্রিকেট কিটসের ব্যাগ নিয়ে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন। মাকে বলেছিলেন ক্রিকেটার হতে যাচ্ছি। অচেনা শহর। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জেদ। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম দেখিয়ে বন্ধুদের বলেছিলেন, একদিন ওখানে খেলবেন। ছোট্ট থেকে নিজের জন্য লক্ষ্য রেখেছেন। আর লক্ষ্যপূরণের জন্য ঘাম ঝরিয়েছেন।
মুম্বইয়ের অন্ধকার, ভাঙাচোরা ক্লাব টেন্টে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন। কোনও কোনও দিন অর্ধাহারে কেটেছে। পরিবার থেকে দূরে। স্বপ্নটাকে কিন্তু মরতে দেননি যশস্বী জয়সওয়াল। পারথের অপটাস স্টেডিয়াম বাইশ বছরের তরুণ তুর্কির আরও এক স্বপ্ন পূরণের সাক্ষী হয়ে থাকল।
শুধু নিজের লক্ষ্যপূরণ নয় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আরও একঝাঁক আগামীর প্রতিভাকেও। আজাদ ময়দানের অন্ধকার ভাঙাচোরা ক্লাব তাঁবু থেকে নিজের বাড়িতে যশস্বীকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোচ-মেন্টর জোয়ালা সিং।
আজ যশস্বীই কোচকে বিশাল ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন! যেখানে বড় হচ্ছেন আরও একঝাঁক আগামীর ক্রিকেটার। প্রিয় ছাত্রের আর্থিক সাহায্যে দেশকে আরও অনেক ‘যশস্বী’ উপহার দিতে ঘাম ঝরাচ্ছেন জোয়ালা।
যশস্বী শুধু তাই জীবন যুদ্ধে জিতে সাফল্যের চূড়োয় পৌঁছোনোর গল্প নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। সবে বাইশে পা। অথচ, নিজের সমবয়সিদের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার স্বপ্নপূরণে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। অর্থের ঝাঁপি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন! দিয়েছেন মাথার ওপর ছাদ। খেলার সামগ্রী, খাবার।
তারুণ্যের তেজ, সাফল্যের খিদে, পরিণত মস্তিষ্ক-বাইশেই আগামীর ‘কিং’ হয়ে ওঠার আস্ফালন। সুনীল গাভাসকারের কথায়, আগামীদিনে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে পদানত করবে। বাইশ গজেই শুধু নয়, মাঠের বাইরেও যথার্থ অর্থেই ‘রাজা’ যশস্বী।
অন্ধকার থেকে আলোয় পা রেখেও কঠিন সময় ভুলে যাননি। ভুলে যাননি নিজের মতো ঘরবাড়ি ছেড়ে মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানের ক্লাবতাঁবুতে রাত কাটানো খুদে ক্রিকেটারদের যন্ত্রণা। মানুষ যশস্বীও তাই স্পেশাল জোয়ালা, তার ক্রিকেট-কোচিংয়ের ছাত্রদের কাছে।
যশস্বীর কোচ নিজেও গত নয়ের দশকে একই স্বপ্ন নিয়ে পা রেখেছিলেন বলিউড নগরীতে। সফল হননি। অপূর্ণ স্বপ্নটাকে যশস্বীর মাধ্যমে পূরণের নেশা চেপে বসে। লক্ষ্যপূরণ কোচ-ছাত্রের।
২০১৩ সালে প্রথম দেখা নাটকীয়ভাবে। আজাদ ময়দানে ছোটদের খেলার মাঝে রীতিমতো হইচই। একজন ব্যাটারের দাবি, জঘন্য পিচ, ব্যাটিং অসম্ভব। সেই উইকেটে ছোট্ট একটা রোগাপাতলা ছেলেকে বোলারদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে দেখে জোয়ালা প্রতিভার গন্ধ পেয়ে গিয়েছিলেন।
বাকিটা ইতিহাস। ক্লাব টেন্ট থেকে বছর দশেকের ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িয়ে নিয়ে যান। যশস্বী হয়ে ওঠে পরিবারের একজন। শুরু হয় নতুন লড়াই। যশস্বীর খিদেটা উসকে দিয়েছিলেন জোয়ালা। যশস্বীর ঠিকানা বদলেছে। বাবা-মায়ের জন্য কিনেছেন বিলাসবহুল ঘর। স্যরের জন্যও। যে ছাদের তলায় আরও একঝাঁক ‘যশস্বী’ তৈরির কাজ চলছে।
আপাতত প্রিয় ছাত্রের পারথ-কীর্তির উচ্ছ্বাসে ভাসছেন যশস্বীর কোচ। উত্তরবঙ্গ সংবাদ-কে জোয়ালা বলেছেন, ‘অত্যন্ত পরিণত ইনিংস। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ওপেনিং জুটি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বলে যেভাবে বোলারদের শাসন করল, ওখানেই ইনিংসের টেম্পো তৈরি করে দিয়েছে।’
যশস্বীই ম্যাচের সেরা, জসপ্রীত বুমরাহর যে বক্তব্য ছুঁয়ে গিয়েছে। জোয়ালার যুক্তি, তরুণ সতীর্থকে উৎসাহ জোগাতে বলেছেন। প্রথম দিনে বুমরাহর স্বপ্নের স্পেলই ভারতকে ম্যাচে ফেরায়। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অজিদের নাগালের বাইরে ম্যাচ নিয়ে গিয়েছে যশস্বী। কোচের বিশ্বাস, পারথে শুরু, বাকি সিরিজেও জারি থাকবে যশস্বী-ধামাকা। যা অনুপ্রেরণা জোগাবে তাঁর বাকি ছাত্রদের।