সৌরভ মজুমদার
ক্লাস টুয়েলভের বায়োলজি ক্লাস। মাস্টারমশাই ব্ল্যাকবোর্ডে ছবি আঁকাতে ব্যস্ত- পুরুষ জননতন্ত্র। এদিকে লাস্ট বেঞ্চে ততক্ষণে ফিশফাশ শুরু, এর ঠিক পরেই ওই জিনিসটা আসবে! মুখ চিপে হাসির চাপা গুঞ্জনের মধ্যেই স্যর সরাসরি অন্য টপিকে সুইচ করে গেলেন। পরীক্ষার জন্য স্যরের মতে এটুকুই নাকি যথেষ্ট! এই পরিচিত ক্লাসরুমের ছবি যতটুকু আমার, ততটুকু আপনারও। এভাবেই বন্ধু মুখে মিথ সেজেছে মিথ্যে, মিথ্যের গায়ে পড়েছে সত্যির পালিশ। মোটামুটি আমাদের বয়সি সকলেই একই অভিজ্ঞতার শরিক।
নব্বই ও শূন্য দশকের সামাজিক মাধ্যমহীন পৃথিবীর এটাই গূঢ় সত্য। আমাদের বড় হয়ে ওঠার পৃথিবী থেকে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ অনেক দূরে ছিটকে গিয়েছে আমাদের বেঁচে থাকার এই পৃথিবী। দূরদর্শন, কেবল টিভির যুগ পেরিয়ে- মোবাইলের স্ক্রিনে স্ক্রল করছে আমাদের সভ্যতা। সেখানে ওয়েস্টার্নাইজেশনের ছাপে দেশীয় সংকট। সাংস্কৃতিক প্রশ্নচিহ্নের সামনে জীবনবোধের প্রকট বিপন্নতা। বেলাগাম ক্রাইম সিন। পার্টি অ্যানিমাল স্ট্যাটাস সেঁটে নেশার এনসাইক্লোপিডিয়ায় বয়ঃসন্ধির বিপদ। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের পৃথিবীর ভেতরে যে যৌনতার গন্ধ- তাতে জেন জি ভুলেছে মন, চিনেছে হরমোন। জীবনশৈলীর রক্ষাকবচের থেকে দূরে তার অনন্ত বিস্তার। সঠিক জীবনদর্শনের অভাব সুসংহত আগামীর পথের প্রধান অন্তরায়। জীবনশৈলী বলতে মূলত যাপনের ধরন বা পদ্ধতিকেই বোঝায়। জীবনযাত্রার পদ্ধতি, অভ্যাস, আচরণ, পছন্দ, অপছন্দ, শারীরিক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সবটা মিলিয়েই জীবনশৈলীর মূল কাঠামো নির্মিত।
আমরা ক্রমশ সরে আসছি আমাদের শিকড় থেকে। আন্তর্জাতিকতাবোধ ও নিও লিবারাল ইকনমির দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষ আদতে কনজিউমার। আর এই ভোগবাদের বিবর্তিত দর্শনেই লেখা হচ্ছে বর্তমান সময়ের ইতিকথা। আমাদের প্রাচীন বিশ্বাস টলমল। জেন জি রিলেশনশিপের অভিধানে জায়গা করে নিয়েছে সিচুয়েশনশিপ, ব্রেডক্রাম্বিং, পকেটিং- এর মতন শব্দ। সমস্ত আবেগের জন্য রকমারি নাম। আবেগ বিক্রির শপিং মলে নৈতিকতার ভিন্টেজ হাইলাইট। এই যে আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে সম্পর্কের অনায়াস ছন্দপতন- সেক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য তেমনি বিবিধ চাহিদার অস্তিত্বকে বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাও কম দায়ী নয়। ঠিক এবং ভুলের স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারিত না থাকলে ভুলপথে চালিত হওয়াই স্বাভাবিক। এখানেই আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ পালটে দিতে পারে বর্তমান এই সমীকরণকে। আলোচনা কীভাবে বদলে দিতে পারে আশপাশের আবহ তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ- পিরিয়ড নিয়ে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারমূলক আলোচনা, প্যাডম্যানের মতন চলচ্চিত্র নির্মাণ। ঠিক এখানেই জেন জি দুনিয়া, সমরেশ মজুমদারের ‘মনের মতো মন’ উপন্যাসের পুরুষ চরিত্রদের সামনে লিখে দেয় নতুন পৌরুষের সংজ্ঞা। আমি বিশ্বাস করি শেখালে সবই শেখা যায়।
তাই তো এখন স্কুলে স্কুলে গুড টাচ ও ব্যাড টাচ শেখানো হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। স্পর্শের সাদা-কালো বোধের ভেতর লুকিয়ে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার স্বর। শিশুদের প্রতি যৌন শোষণের বিরুদ্ধে যেমন এটি যথার্থ পদক্ষেপ তেমনি এই বিষয়ে শিক্ষাদান মানে বাকিদেরও পরোক্ষভাবে সচেতন করে দেওয়া- ব্যক্তিগত শরীরী ভাষায় নিয়ন্ত্রণ কায়েমের সহজ পাঠে। জীবনশৈলী পাঠ কমাতে পারে জুভেনাইল ক্রাইমের ৬.৯ শতাংশ নথিভুক্ত কেসের পরিসংখ্যানকে। এক সুনিশ্চিত সকাল উপহার দিতে পারে সকলকে।
(লেখক পেশায় সরকারি আধিকারিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)