- দীপায়ন বসু
কোনও রাখঢাক নেই। সব জলের মতো স্পষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গিয়েছে মিমে। ‘টাকা দিলে সবই হয়!’ মজার বিষয় হল, দলের লোকেরাও ব্যাপারটা অস্বীকার করছেন না। স্বীকার করছেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই তো, টাকা দিলে সব হয়!’ হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? আরে, হেঁয়ালির কিছু নেই। খুব সাধারণ বিষয়। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। মাস গেলে মহিলাদের হাতে হাজার টাকা। এসসি/এসটি হলে ২০০ টাকা বেশি।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বিষয়ে জানতে খোঁজ করলে গুগল জানাবে, ১৯০৪ সালে কলকাতার বৌবাজারে এই নামে (লক্ষ্মীর ভাণ্ডার) একটা দোকান খোলা হয়েছিল। সেখানে পুরোপুরিভাবে স্বদেশি সামগ্রী বিক্রি হত। দেশের মানুষের স্বদেশি জিনিসপত্র কেনার ঝোঁক বাড়াতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী দোকানটি চালু করেছিলেন।
২০২১ সালে আসা যাক। রাজ্যে সে বছরের এপ্রিলে বিধানসভা ভোট। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার একই নামে একটা প্রকল্প চালু করল। মাস গেলে সাধারণ ঘরের (গরিব হন বা ধনী, কোনও ভেদাভেদ নেই) মহিলারা পাবেন ৫০০ টাকা আর তপশিলি জাতি/তপশিলি উপজাতিভুক্ত মহিলারা পাবেন দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১০০০। গোড়া থেকেই এই প্রকল্প বেশ হিট। সেবারের ভোটেও হেলায় জিততে তৃণমূল কংগ্রেসের সমস্যা হয়নি।
সেবারের পর এবার। মানে এ বছরের লোকসভা ভোট। রাজ্যে পদ্মের জোর প্রভাব ফেলার চেষ্টা। ঘাসফুলকে কিন্তু পথ দেখালেন সেই লক্ষ্মী। ৫০০ টাকা বেড়ে হল ১০০০ টাকা। আগে এই প্রকল্পে যাঁরা ১০০০ টাকা পেতেন, তাঁদের প্রাপ্তি বেড়ে হল ১২০০ টাকা। ভোটের ফল কী হবে, তা নিয়ে অনেকে উদ্বেগে ছিলেন। বুথফেরত সমীক্ষার পাল্লাও ছিল পদ্ম শিবিরের দিকে ভারী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু গোড়া থেকেই ভোটের ফলাফলের বিষয়ে বেশ নিশ্চিত ছিলেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারই যে তাঁর তুরুপের তাস, সেটা ভালো করেই জানতেন। ফল প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেল, তিনি এতটুকু ভুল নন। কী করে ভোটে জিততে হবে, সেই ছকটা আগেভাগে ভালোমতো ছকে নিয়েছিলেন।
ধান ভাঙতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলে সোজা ‘টু দ্য পয়েন্টে’ যাওয়া যাক। আজকালকার দিনে ১০০০ টাকায় কী হয়? মোটামুটি খাওয়ার মতো চালের একটি বস্তাও এই টাকায় পাওয়ার কথা নয়। একটু ভারী ধরনের অসুখবিসুখ করলে, মাসকাবারি ওষুধের খরচও উঠবে না। হয় না বলেই কোনও মা তার শিশুকে স্টেশনের ধারে ফেলে রেখে যান। দারিদ্র্যক্লিষ্ট সংসারে ওই টাকায় সেই শিশুর ভালোমতো যত্নআত্তি সম্ভব হবে না ধরে নিয়ে। সেই শিশুদের মধ্যে ‘ভাগ্যবান’ কারও কারও হোমে ঠাঁই হয়। আরও ভাগ্যবানদের কেউ কেউ নতুন বাবা–মায়ের হাত ধরে ভিনদেশে পাড়ি দেয়।
খবরের কাগজে সে সব খবর বের হলে আমরা খুশি হই। কিন্তু ভিতরের সমস্যা? সেটা মেটাতে মোটেও তৎপর হই না। হলে হোমের শিশুদের ভিনদেশে পাঠানোর প্রয়োজনই পড়ত না। ছোটদের ছেড়ে বড়দের কথায় আসা যাক। প্রতিবার ভোটের আগে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার ঢল নামে আর ভোট শেষে কাজের জায়গায় ফেরার। নিয়মমতো তা এবারও হয়েছে। কেমন হয়, যদি এই মানুষদের জন্য ‘নারায়ণ ভাণ্ডার’ চালু করা হয়? সংসার চালানোর মতো কিছু টাকা হাতে পেলে তাঁরা কখনোই যে বাড়িঘর ছাড়তেন না, এটা বারে বারে স্পষ্ট করেছেন।
লোকসভা ভোট চুকেবুকে যাওয়ার পর অবধারিতভাবে এখন নজর ২০২৬–এ। সেবার রাজ্য ভোট। বিধানসভা দখলের পালা। এটা সবাই জানে, সেই ভোট উতরোতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সেবারও ঘাসফুল সরকারের অন্যতম হাতিয়ার হবে। প্রশান্ত কিশোরের মতো ভোটকৌশলী হওয়ার প্রয়োজন নেই, মোটামুটি জানাই আছে, হাতে গুঁজে দেওয়া ১০০০ টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে ১২০০–১৩০০ টাকা করে দিলেই কেল্লা ফতে। ৫০০ টাকা বাড়ানোর ফর্মুলায় ১৫০০ টাকা হলে তো কথাই নেই। ভোটব্যাংক উপচে পড়বে।
কিন্তু সমস্যা? সেটা মিটবে কি? বরং প্রকৃত গরিব পরিবার চিহ্নিত করে যদি মাসে তাদের জন্য অন্তত হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা করা যায়, সেটা তাদের জন্য অনেক। সেই টাকা পেলে আর হয়তো কোনও মা তাঁর সন্তানকে স্টেশনের পাশে রেখে যাবেন না। পরে সেই শিশুকে নতুন বাবা–মায়ের হাত ধরে ভিনদেশে পাড়িও দিতে হবে না। নিজের বাবা–মায়ের কাছেই সে সস্নেহে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
আমাদের দেখতে হবে আমাদেরই। সরলা দেবীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও কিন্তু সেটাই চেয়েছিল।