উত্তরবঙ্গ ব্যুরো: আজ ২৫শে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত দেশজুড়ে কবিগুরুর জন্মদিন পালিত হল। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় উৎসাহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দিনটি পালন করা হয়। বুধবার কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাটে কয়েকজন রবীন্দ্র অনুরাগীর উদ্যোগে নৌকায় রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হয়। রবি ঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে গান আবৃত্তির আসর বসে নৌকাতেই।
জলপাইগুড়ি জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের তরফে কবিপ্রণাম অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ররীন্দ্র ভবনে। ১৬৩তম রবীন্দ্র জয়ন্তীতে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন অতিরিক্ত জেলা শাসক ধীমান বাড়ই। পাশাপাশি রবি ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে প্রণাম জানান সদর মহকুমা শাসক তমোজিৎ চক্রবর্তী, জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক স্বরূপ বিশ্বাস, এসডিআইসিও ইন্দজিৎ সাহা। এরপর সমবেত সংগীত, আবৃত্তি, নাচ ও শ্রুতি নাটকে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা অডিটোরিয়াম।
মেটেলি ব্লকেও সাড়ম্বরে পালিত হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী। এদিন ব্লকের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মাটিয়ালি বাতাবাড়ি-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস ও চালসা গোলাইয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা ও মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মজয়ন্তী পালন করা হয়। শেষে সকলকে মিষ্টিমুখও করানো হয়। এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাটিয়ালি বাতাবাড়ি-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দীপা মিজার সহ অন্যান্যরা। এদিন মেটেলি, চালসা, বাতাবাড়ি, ধূপঝোরা, বিধাননগর সহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়।
অন্যদিকে, নিউ কোচবিহার প্রান্তিক নাট্যগোষ্ঠীর অভিনব উদ্যোগে ট্রেনের কামড়ায় পালিত হল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। এদিন সাতসকালেই আলিপুরদুয়ার জংশন বামনহাট ট্রেনের যাত্রীদের আরমোরা ভাঙার আগেই মুখরিত এই অনুষ্ঠান সকলের নজর কাড়ল। নিউ কোচবিহার প্রান্তিক নাট্যগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ জন সদস্য এদিন কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী পালন করতে চেপে বসেন এই ট্রেনে। সেখানে যেন কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। সাংস্কৃতিক মঞ্চ না থাকলেও ট্রেনের কোচই হয়ে উঠেছিল সেই মঞ্চ। সকাল ৭টায় নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয় তাদের। তারপর বামনহাট হয়ে ওই ট্রেনেই বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ নিউ কোচবিহার স্টেশনে শেষ হয় তাদের কবি গুরু জন্মজয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠান। ট্রেনের বাইরের অংশ ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। ভেতরে ছিল কবিগুরুর প্রতিকৃতি। সাতসকালে সেখানে কবি প্রণাম দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। তারপর একে একে কবিগুরুর ছাত্রের পরীক্ষা নাটক থেকে শুরু করে চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনৃত্য, আবৃত্তি, রবীন্দ্র সংগীত বাদ ছিল না কোন কিছুই।
প্রান্তিকের নির্দেশক স্বপন দত্ত জানান, তাঁরা ২০১২ সাল থেকে এই ট্রেনে অভিনবভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করে আসছেন। করোনার কারণে ২০২১-২২ সালে দু’বছর তা হয়নি। ২০২৩ সালে অবশ্য কোচবিহার শহরের হেরিটেজ দোতলা বাসে করে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। এবছর ফের ট্রেনে করা হল। রেলযাত্রী থেকে রেলকর্মী সকলেই এই অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছেন।
নাগরাকাটায় একাধিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বকবির স্মরণে এগিয়ে আসে। নাগরাকাটা সাংস্কৃতিক মঞ্চের তরফে সকালে বর্ণাঢ্য প্রভাত ফেরির মাধ্যমে কবি প্রণামের কর্মসূচি শুরু হয়। ১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক লাগোয়া রবি-ভানু মোড়ে বিশ্ব কবি ও সেই সঙ্গে নেপালি ভাষার আদিকবি ভানুভক্তের মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন রবীন্দ্র অনুরাগীরা। ছিলেন নাগরাকাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সঞ্জয় কুজুর, সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক নিবেদিতা সরকার। সন্ধ্যায় আদিবাসী সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে আয়োজিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সেখানে কবির রচিত গীতিনাট্য বাল্মিকী প্রতিভা মঞ্চস্থ করে তাক লাগিয়ে দেয় এলাকার নয়া প্রজন্মের কলাকুশলীরা। আরেকটি সংস্থা সৃজনীর তরফেও এদিন সকালে কবিকে স্মরণ করা হয়। পুরো আয়োজনই ছিল সাবেকিয়ানায় মোড়া। রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে হাতে গাঁথা জুঁই ফুলের মালা পড়িয়ে দেওয়া হয় দই-চিড়ের ভোগ।
মেখলিগঞ্জের অপরাজিতা অর্পন সাহিত্য গোষ্ঠীর তরফে চ্যাংরাবান্ধা গ্রাম পঞ্চায়েতের চৌরঙ্গী এলাকার সুটুঙ্গা নদীর তীরে চা বাগানের মাঝে এক অভিনব প্রাকৃতিক রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করা হয়। নাচ, গান, কবিবাসর, রবীন্দ্র বিষয়ক আলোচনায় অনুষ্ঠান স্থল মুখরিত হয়ে উঠেছিল। মেখলিগঞ্জ ব্লকের বিভিন্ন জায়গার কবি সাহিত্যিকরা এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অপরাজিতা অর্পনের সম্পাদক কুনাল নন্দী বলেন, ‘প্রত্যেক বছর আমরা রবীন্দ্র জয়ন্তীতে কিছু নতুনত্ব করার চেষ্টা করি। গতবছর আমাদের তরফে ট্রেনে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করা হয়েছিল। এবছর প্রকৃতির মাঝে রবি ঠাকুরের জন্মদিন উদযাপন করলাম। কবি চিরকাল প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন। তাই প্রকৃতির মাঝেই তাকে খুঁজে নিয়েছি আমরা।’ অনুষ্ঠান শেষে সকলের হাতে অপরাজিতা অর্পন স্মারক তুলে দেওয়া হয়। চ্যাংরাবান্ধা ছন্দম শিল্পীগোষ্ঠীর তরফে নাচে গানে মুখরিত একটি রাবীন্দ্রিক শোভাযাত্রা সকালে চ্যাংরাবান্ধা পরিক্রমা করে। সন্ধ্যায় চ্যাংরাবান্ধা ক্লাব টাউন লাইব্রেরীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
অন্যদিকে, গাজোলেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থার তরফে রবিস্মরণের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু গাজোল বাসস্ট্যান্ডে রবি ঠাকুরের যে আবক্ষ মূর্তি রয়েছে আজ সারাদিনে তার গলায় জুটল না একটা গাঁদা ফুলের মালাও। সারাদিন বলতে গেলে অনাদরেই পড়ে রইলেন রবি ঠাকুর।
গাজোল শহর এলাকার কেন্দ্রস্থল গাজোল বাসস্ট্যান্ডে রয়েছে রবি ঠাকুরের এই আবক্ষ মূর্তি। শুধু রবি ঠাকুর নয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অনেক মনীষীদের মূর্তি রয়েছে। তবে মূর্তি স্থাপন করা হলেও এই সমস্ত মনীষীদের জন্মদিনে একটা মালাও জোটেনা। এর আগে দেখা গেছে স্বামী বিবেকানন্দ কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতেও সন্ধ্যে পর্যন্ত জোটেনি মালা। এদিন সন্ধ্যেবেলা বিষয়টি নজরে আসে উত্তরবঙ্গ সংবাদ এর প্রতিনিধিদের। ছবি তোলার উদ্যোগ নিতেই এগিয়ে আসেন পথ চলতি বেশ কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে একজন রাজু সিং। তার উদ্যোগেই বেশ কিছু যুবক ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে মূর্তি। এরপর তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে দেওয়া হয় রজনীগন্ধার মালা। অন্যদিকে, নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কবিগুরুর জন্মদিন পালন করল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংস্থা।