সন্দীপন নন্দী: দুর্গাপুজো প্রগতিশীল জাতির যেন প্রিয় উৎসবসমগ্র। যার কাছে সঞ্চিত থাকে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ফলে যাবতীয় সুখসমৃদ্ধি প্রার্থনার একমাত্র কাল হয়ে ওঠে এই নন্দিত শরত। বাঙালির শতসহস্র যাতনা নিবারণের সেরা পার্বণ এই দুর্গোৎসব। সারাবছরের অনিদ্রা, শোক, অপ্রাপ্তিকে ম্যাজিকের মতো মুছে দিতে এগিয়ে আসে যে সময়ে বৃত্তান্ত। তাই নতুন ক্যালেন্ডারের এই আশ্বিন মাসের বর্গক্ষেত্রেই প্রথম চোখ যেত বাঙালির। হতদরিদ্র মানুষ থেকে পুঁজিপতিরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মতো যাপন করতেন এই চারদিন। ভালো খাওয়া, ভালো পরাটাই সুখস্মৃতি হয়ে বিরাজ করত। একসময় অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে প্রাণ, ছিল শারদীয়ার আপ্তবাক্য।
অথচ চা বাগান, অনাথ শিশু, বৃদ্ধাশ্রমগুলো ক’দিন যে বাঙালির বিচরণের রাজধানী ছিল, তারাই সব বিস্মৃত হয়ে আপন ঐশ্বর্যের সন্ধানে আজ বিমুখ। আনন্দ প্রসাদের মতো বিতরণেই যার আসল মর্ম, এ বর্ণনায় বদল এল সহসা। একটা জাতির ঐতিহ্য চুরমার হল নীরবে। বাঙালি খাবার, বাঙালি রান্না, বাঙালি সাজপোশাকের নামে হাঁসজারু সংস্কৃতি আয়ত্ত করে হ্যাপি মহালয়ার পোস্ট দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাড়াপড়শিরা। নিদ্রামগ্ন বাঙালি অষ্টমীর ডিজেতে শুনল, তব অচিন্ত্য। হড়পার পর প্রলয়পথে প্রাণের যে নগণ্যচিহ্ন পড়ে থাকে, বাঙালিয়ানাও আজ সেরকম।
যার কাছে পুজো মানে বৃদ্ধ মা-বাবাকে কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে জয়সলমের। যে পুজোর সারাংশ এখন, শেষরাতে অমানুষ হয়ে বাড়ি ফেরা। পুজো মানেই ঘরে ঘরে নতুন ফোর হুইলার। এখন পুজো মানে নিযুত নিয়ম লহমায় চুরমার করে আত্মমগ্ন বাঙালির একা একা বেঁচে থাকা। পুজো মানে এখন আর পুজোসংখ্যা নয়। পুজো এখন আর পুজোর গানও নয়। পুজো এখন আপন স্বার্থ নিয়ে হুড়োহুড়ির মানবিক উদযাপন।
তাই পুজোর অজস্র স্মৃতি বিস্মৃত হতে এ প্রজন্মের লাগল মাত্র কয়ে দশক। যে ঐতিহ্যের বিপর্যয়ে কোনও স্মরণসভার আয়োজন করতেই পারে বাঙালি। কারণ এখন মানুষ আর গান শোনে না, গান দেখে। ফলে দিকে দিকে রয়ে যায় এক নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এরপর পাড়ার ক্লাবে ক্লাবে মানুষের ঢল নামবে। চারদিন সেলিব্রেট করবে ইউনেসকোর মেডেল জেতা দুর্গাপুজো।
অথচ কতকিছু করা যে বাকি ছিল, সে হিসেবের খাতাটা সবার মতো এই ক্লাবগুলোও হারিয়ে ফেলল। পাড়ার লক আউট কারখানার হিরণকাকুর আগামী কেমোর জন্য ছলাখ টাকা প্রযোজন, ক্লাব সম্পাদক জানেন না। পেনশনহীন তনুজবাবু দু’বেলা খাবারটাও ঠিকঠাক পান না, সম্পাদক জানেন না। সেই দর্জি আলতাফ চাচার মেয়ে কত কষ্টে বোস ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো, সম্পাদক জানেন না। জানেন না ক্লাবের ফাউন্ডার মেম্বার অরণিদা, বিভু জেঠু, স্বরাজ কাকুরা ভালো আছেন কি না। পুজোমণ্ডপের অদূরে বিস্তৃত বনবস্তিতে সদ্য জন্মানো বাচ্চাগুলো ঠিকঠাক ভ্যাকসিন পাচ্ছে কি না। তাদের খাবার আছে কি না।
না, এসব প্রশ্নের জবাব একটা রাজ্যের ক্রাউডপুলার কোনও দুর্গাপুজো কমিটির সম্পাদকের কাছে নেই। শুধু ওয়ার্ড কমিশনারের ফোন নম্বর দিয়ে দায়িত্ব সেরেছিলেন ক্লাব সম্পাদক।
একটা নিভৃত দিনমালা উৎসবের পঞ্জিকায় জায়গা করে নেয়, যার প্রথম ও শেষ বলে কিছু নেই।
তবে কি এটাই বাঙালির লাস্ট পুজো আপডেট? এই আশ্চর্য চরিত্র নিয়ে আমরা ওয়ালে স্ট্যাটাস দেব। পুজো বদলে যাচ্ছে বলে তর্ক করব। সব শুনে বুঝেও চিৎকার করে বলব, আসছে বছর আবার হবে।
(লেখক বালুরঘাটের বাসিন্দা। সাহিত্যিক)