প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: এইচ ডি দেবগৌড়া, আবু তাহের খান এবং দোলা সেন। একজন দাক্ষিণাত্যের, দু’জন বঙ্গ সন্তান। তিন সাংসদই এখন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মহলে আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় এবং কর্তব্যনিষ্ঠার নয়া ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’। অন্তত এমনটাই মনে করছেন সংসদ ভবনের সর্বস্তরের কর্মচারী ও আধিকারিকরা৷ শারীরিক অসুস্থতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শুধু হুইলচেয়ারে চেপে তিন সাংসদই যেভাবে পার্লামেন্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তা দেখে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে শাসক-বিরোধী সকল পক্ষের। তাঁদের দেখে একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে উষ্ণ করমর্দন করে নিঃশব্দে প্রশংসা ও অভিবাদন জানাতে ভুলছেন না কেউ।
দেবগৌড়া, দোলা সেন এবং আবু তাহের হলেন সেই বিরল শ্রেণির সাংসদ যাঁরা প্রতিদিন নিয়ম করে পার্লামেন্ট আসেন, অবশ্য পায়ে হেঁটে নয়, আসেন ‘হুইলচেয়ারে’ চেপে। কষ্ট করে তাঁদের ওঠানামা করতে হয়, গাড়ি থেকে নামা ও ওঠার সময় এখনও দরকার হয় সাহায্যের, মাঝেমধ্যে যন্ত্রণায় বেঁকে যায় মুখ, তবুও শুধু ‘অস্বাভাবিক’ ‘মনের জোর’ সম্বল করে প্রতিদিন ঠিক সময়ে সংসদ ভবনে হাজির হন এই ত্রয়ী, সভার কাজ মুলতুবি হলে দলনেতার অনুমতি নিয়ে তবেই পার্লামেন্ট ছাড়েন। শারীরিক সমস্যাকে গুণে গুণে দশটা গোল দিয়ে প্রতিদিন এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারছেন কি করে? মজার বিষয়, তিন সাংসদের উত্তরও এক-সংসদীয় গণতন্ত্র এবং দলের প্রতি আস্থা, ভালোবাসা।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে জেডিএস সুপ্রিমো তথা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এইচ ডি দেবগৌড়া পার্টি সদস্যদের জানিয়েছিলেন, তিনি আর নির্বাচনে লড়তে চান না। দেবগৌড়ার বক্তব্য, ‘হুইলচেয়ারে চেপে পার্লামেন্টে যেতে চাই না।’ দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ৯০ বর্ষীয় দেশের প্রাক্তন একাদশতম প্রধানমন্ত্রী। হৃদযন্ত্র দুর্বল, স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে, হাই ডায়াবেটিক, স্নায়ু রোগে আক্রান্ত, ক্ষীণ দৃষ্টি, রয়েছে কিডনির সমস্যা, হাত-পা নাড়াতে পারেন না, এছাড়াও মেডিকেল রেফারেল সেন্টারের দাবি একাধিক বার্ধক্যজনিত রোগে দীর্ঘদিন ধরে জেরবার দেবগৌড়া। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০১৯-এর নির্বাচনে দাঁড়াননি। কিন্তু হুইলচেয়ারে চেপে সংসদে না চাওয়াটা শেষমেশ হয়ে ওঠেনি। দলই তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ করে পাঠিয়েছে। এর পরেও শত কষ্টের মধ্যেও প্রত্যহ দু’জন অ্যাটেন্ডেন্ট সঙ্গে নিয়ে নিয়ম করে সংসদে আসছেন দেবগৌড়া।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর ফের রাজনীতির ময়দানে মুর্শিদাবাদ লোকসভার তৃণমূল সাংসদ আবু তাহের খান। প্রায় সাত মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। গত ১৯ এপ্রিল তিনি স্নায়ু ও ফুসফুস সংক্রমণের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু এখনও হুইলচেয়ারেই করছেন চলাফেরা। সম্প্রতি হুইলচেয়ারে চেপেই দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে সশরীরে হাজির থাকছেন সাংসদ। জেলা তৃণমূলের বিজয়া সম্মিলনী, দলের প্রাক্তন ও প্রয়াত জেলা সভাপতিদের স্মরণ অনুষ্ঠানেও হাজির ছিলেন তিনি। ২৩ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের সাংগঠনিক সভা উপলক্ষ্যে বহরমপুরের প্রস্তুতি সভাতেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের সভাতেও হাজির হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দিল্লির রাজঘাট ও যন্তরমন্তরে দলের কর্মসূচিতেও হুইলচেয়ারে বসে হাজির হয়েছিলেন তাহের। সেই সময় লোকসভার অধ্যক্ষকে দেখা করে জানিয়েছিলেন তিনি সুস্থ। শীতকালীন অধিবেশনেও হুইলচেয়ার চেপেই প্রতিদিন যোগ দিচ্ছেন আবু তাহের খান। একইভাবে সংসদ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আরেক ‘হুইলচেয়ার সাংসদ’ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ দোলা সেন। সম্প্রতি রাজ্যে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়েন দোলা, ভেঙে যায় তাঁর পা। প্লাস্টার লাগানো ছিল বহুদিন। একটু সুস্থ হতেই হুইলচেয়ার চেপেই হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছেন এই ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী৷ শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন একদিনও রাজ্যসভায় অনুপস্থিত ছিলেন না৷ হুইলচেয়ার চেপেই সংসদ ভবনের এমাথা-ওমাথা চষে ফেলেছেন, অংশ নিয়েছেন সাংবাদিক সম্মেলনেও।
অতীতে হুইলচেয়ার চেপেই কর্তব্যপালনে ব্রতী হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো শিবু সোরেন, আরজেডি চিফ লালুপ্রসাদ যাদব, এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রথিতযশা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। জুলাই মাসে উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতা ফেরার সময় দুর্যোগের কবলে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টার। এই ঘটনায় পায়ে চোট পান মুখ্যমন্ত্রী। এরপর তাঁর হাঁটুর সমস্যার কথা জানা গিয়েছিল। অস্ত্রোপচার করতে হয় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। সে সময়ে পায়ে প্লাস্টার নিয়ে হুইলচেয়ার চেপেই বাড়ি ফেরেন তিনি। হুইলচেয়ার চেপেই পরবর্তী সময়ে অংশ নিয়েছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলীয় কর্মসূচিতে। তাঁর সেই নাছোড়বান্দা মানসিক জোরে অনুপ্রাণিত হয়েই হুইলচেয়ার চেপে শীতকালীন অধিবেশন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরই দলের দুই সাংসদ। এরই পাশে অশীতিপর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার হুইলচেয়ারে চেপে সংসদ ভবনে সক্রিয় উদ্দীপনা সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে সকলের।