- সুমন ভট্টাচার্য
কেউ অভিনেতা, কেউ বিচারপতি, আবার কেউবা পদকজয়ী কুস্তিগির হয়ে প্রতিবাদের মুখ। ২০২৩-এ তাঁরাই কেড়ে নিয়েছেন প্রচারের সব আলো। বিতর্কে অথবা সাফল্যে, তাঁদের থেকে আমরা চোখ সরাতে পারিনি। বছরের শেষে এসে এইরকম দশজন ভারতীয়কে দেখার চেষ্টা। এই তালিকায় থাকা কেউ রাজনীতিক নন, কিন্তু রাজনীতির ন্যারেটিভ নির্মাণে তাঁদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। কেন এই দশজন, বছরের শেষে কেন তাঁরাই যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, তাও বিশ্লেষণের চেষ্টা।
তিন কুস্তিগির
কৃষি বিলের প্রতিবাদে রাজধানী অবরুদ্ধ করে রাখা কৃষকদের সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া আর যদি কোনও বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে গত নয় বছরে পিছু হটতে হয়ে থাকে, তাহলে তা কুস্তিগিরদের বিক্ষোভের সামনে। সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগত এবং বজরং পুনিয়া। তিন কুস্তিগির প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রতিবাদকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেলে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শা-রাও নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতে পারেন। কারণ শেষপর্যন্ত ব্রিজভূষণ তাঁর অনুচরদের ভোটে জিতিয়ে এনে ভারতয় কুস্তি ফেডারেশনের নতুন যে কমিটি তৈরি করেছিলেন, কেন্দ্র তাকে বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে। দিল্লির রাজপথে ধর্না, লাগাতার প্রতিবাদ এবং তারপরে শেষপর্যন্ত সাক্ষীর অবসরের সিদ্ধান্ত, আর বজরংয়ের পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেওয়া, আধুনিক ভারতে সত্যাগ্রহ-এর নতুন নজির হয়ে থাকল।
ডিওয়াই চন্দ্রচূড়
সমকামীদের বিবাহের আইনগত স্বীকৃতিকে এড়িয়ে যাওয়া হোক কিংবা কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপকে সাংবিধানিক আখ্যা দেওয়া, গোটা বছরের ভারতীয় রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে কেন্দ্র করে। এবং সেই কারণেই সবসময় খবরের শিরোনামে থেকেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বাবাও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন, আর ডিওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পছন্দ-অপছন্দকেও বিশেষ লুকোন না। সেই কারণেই তাঁর বিশেষভাবে সক্ষম দুই কন্যার সঙ্গে বাড়িতে সময় কাটানোর ছবি ভাইরাল হয়, আবার তিনি সর্বোচ্চ আদালতের কর্মীদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ অংশগ্রহণের কথা বলেন। সরকার এবং বিরোধী, কাউকেই খুশি না করতে পারা ডিওয়াই চন্দ্রচূড় তাই বছরের সেরা নিউজ মেকার তো বটেই।
শ্রীধর পানিক্কর সোমনাথ
তিনি ১৪০ কোটি ভারতবাসীর স্বপ্নপূরণের ইচ্ছেকে সফল করেছেন। তিনি ইসরোর প্রধান শ্রীধর পানিক্কর সোমনাথ। বৈজ্ঞানিক অভিযানের পরে তাঁর কোন মন্দিরে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হল কিংবা তাঁর আত্মজীবনীর প্রকাশ কেন বাতিল, এইসব অবান্তর বিষয়কে সরিযে রেখে ভাবা যাক তিনি আমাদের কী দিয়েছেন। চাঁদের মাটিতে কোনও ভারতীয় যান পা রাখবে এবং তার সরাসরি সম্প্রচার কোটি কোটি দেশবাসী দেখে উচ্ছ্বাসে বা জোছনায় ভেসে যাবে, এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে! যাযাবর লিখেছিলেন, বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আর ইসরোর প্রধান হিসেবে চন্দ্রযানকে চাঁদের মাটিতে নামিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া হল বিজ্ঞান কুসংস্কারের উপরে যায়।
মহম্মদ সামি
বিশ্বকাপ হয়তো ভারত জিততে পারেনি, কিন্তু মহম্মদ সামি তাঁর স্থান খুঁজে পেয়েছেন। এবং গেরুয়া বাহিনীর কটাক্ষকে উপেক্ষা করে সামির জায়গা পাকিস্তানে হয়নি, বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বুকে তিনি মাথা রাখতে পেরেছেন। আর সেই কারণেই বছরের সেরা দশ অরাজনৈতিক নিউজ মেকার-এর তালিকায় বাংলা থেকে যে দুজন থাকবেন, তার মধ্যে মহম্মদ সামিকে বাদ দেয় এমন সাহস কার! ঘটনাচক্রে বাংলা থেকে দেশের সেরা দশের মধ্যে যে তিনজন জায়গা করে নিয়েছেন, তার মধ্যে দুজনই সংখ্যালঘু। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ হারার পর দেশবাসীর কাছে খলনায়ক আর ট্রোলবাহিনীর কাছে গদ্দার হয়ে যাওয়া পেসারের ফিরে আসার আখ্যানও রূপকথার চাইতে কম নয়।
সুনীল কানুঘলু
রাজনীতিক নন, কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা সবসময় ভরসা রাখেন এই ভোট কুশলীর ওপর। একদা পিকে ওরফে প্রশান্ত কিশোরের সহযোগী, তারপরে গেরুয়া শিবিরের ব্যাকরুম সামলানো সুনীল তাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে কংগ্রেসকে ২০২৩-এর দুটি সবচেযে বড় জয় এনে দিয়েছেন। প্রথমে কর্ণাটক, এবং তারপরে তেলেঙ্গানা। দক্ষিণের দুটি রাজ্যেই রাহুল গান্ধির দলের জয়ের পিছনে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেওয়া হয় কানুঘলুর নিখুঁত বিশ্লেষণ, স্থানীয় সমস্যা খুঁজে বের করা এবং পরিসংখ্যান বোঝার দক্ষতাকে।
শাহরুখ খান
‘বেটেকো হাত লাগানে সে প্যাহেলে বাপ সে বাত তো কর।‘ একটা সংলাপ এবং অনেক না বলা কথা বলিউডের কিং খান-কে ২০২৩-এ যাবতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে। তার সঙ্গে অবশ্যই তিনটি হিট পাঠান, জওয়ান এবং বছরের শেষে ডানকি। এটা সত্যি রাজকুমার হিরানির ছবি ডানকি হয়তো বছরের শেষে তত বড় হিট দিতে পারেনি, কিন্তু সেই ছবি রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখানো হচ্ছে। আর পাঠান এবং জওয়ান যাবতীয় বয়কটের হুমকিকে উপেক্ষা করে শুধু ব্যবসার অঙ্কে ১০০০ কোটি টাকা ছাড়ায়নি, গেরুয়া শিবিরের ট্রোলবাহিনীকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ সময়ে ব্যবধানে ফিরে এসে বলিউডের রোম্যান্স-এর বাদশা তাই সেরাদেরও সেরার তালিকায় থাকবেনই।
অরিজিৎ সিং
বছরের শেষেও তিনিই দেশের জনতার হৃদস্পন্দন। ৮ থেকে ৮০ সবার। সলমন খানের সঙ্গে তাঁর বিবাদ মিটে গিয়েছে কিনা তাই নিয়ে যতটা আলোচনা, ততটাই তাঁর বাউন্ডুলে ঘুড়ি কলকাতার নতুন বুকস্টোরকে প্রেমিক প্রেমিকাদের ফটোশুটের জন্য ফেভারিট ডেস্টিনেশন করে দিতে পারে। তিনি জিয়াগঞ্জে থাকলেও খবর, আবার বিদেশে কনসার্টে গেলেও আলোড়ন। সোনু নিগমের পরে আর কোনও গায়ক বলিউডের তারকাদের ধারাবাহিকভাবে এত হিট হয়তো দেননি। প্রেমে এবং বিচ্ছেদে অরিজিতের গান সকলের মনে পড়বেই।
ববি দেওল
ধর্মেন্দ্র-পুত্র, সানি দেওলের ভাই হয়ে প্রায় অন্তরালে চলে যাওয়া ববি দেওল ২০২৩-এ সংবাদের শিরোনামে। ‘শোলে’ বললেই যেমন প্রথমে গব্বর সিং-এর নাম মনে আসে, তেমনই ‘অ্যানিম্যাল’ ছবির খলনায়ক এবং পর্দায় তাঁর এন্ট্রি সিন-এ ‘জামাল কুদু’ গান নেটদুনিয়ায় একেবারে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে। দেওল পরিবারের এই অভিনেতা তাই আখ্যায়িত হচ্ছেন লর্ড ববি নামে। ‘বরসাত’ দিয়ে জীবন শুরু করা ববি দেওল মধ্যিখানে এমন অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন যে বলিউডে তাঁর পরিচিতি ছিল, ওই যে যাঁর স্ত্রী শাহরুখের বউ গৌরীর খুব বন্ধু। সেই অন্তরাল থেকে প্রকাশ ঝার আশ্রম যদি ববিকে পুনরায় ক্যামেরার সামনে ফেরত এনে থাকে, তো জামাল কুদু বছরের সবচেয়ে বড় হিট।
তৃপ্তি দিমরি
নায়িকা নন, কিন্তু ২০২৩-এ তিনিই ভারতীয় পুরুষদের কাছে সবচেযে বড় ক্রাশ। সন্দীপ বাঙ্গার নারীবিদ্বেষী ছবি ‘অ্যানিম্যাল’ যদি রাতারাতি কাউকে গোটা দেশের নজরে তারকা করে থাকে, তাহলে তিনি পাহাড়ি কন্যা তৃপ্তি। এবং সেই ক্রাশ হয়ে ওঠা দক্ষিণের সুপারস্টার ‘পুষ্পা’ খ্যাত রশ্মিকা মান্দানাকে টপকে। এর আগে অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত ‘বুলবুল’-এ নায়িকা ছিলেন, কিন্তু ‘অ্যানিম্যাল’-এ রণবীর কাপুরের বিপরীতে মিনিট দশেকের উপস্থিতি আর একটি অন্তরঙ্গ দৃশ্য গোটা ভারতকে তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়েছে।
রাজীব কুমার
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরে প্রত্যাবর্তনের আর এক আখ্যান। তিনি সম্ভবত দেশের একমাত্র পুলিশ কমিশনার ছিলেন, যাঁকে সিবিআই ধরতে এলে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছিল। এবং সেদিনের বিতর্কিত পুলিশ কমিশনারকে বাঁচাতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসেছিলেন। চার্লস টেগার্টের পর কলকাতায় যে পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, বিতর্ক হয়েছে, বছরের শেষে এবং আগামী মহাগুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য পুলিশের শীর্ষপদে বসিয়েছেন। বিতর্ক বাদ দিলে গোটা দেশের পুলিশ মহল আইআইটির এই প্রাক্তনীকে চেনে দুঁদে গোয়েন্দা এবং সন্ত্রাসদমনে দক্ষ অফিসার হিসেবে। তদন্তে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয় তার চমৎকার সব প্রয়োগ রাজীব কুমার দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখিয়েছেন।