প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত (Batukeshwar Dutt)। ভারতের মুক্তিযোদ্ধা ভগৎ সিংয়ের সহকারী বটুকেশ্বর দত্ত ১৯১০ সালের ১৮ নভেম্বর অধুনা পূর্ব বর্ধমান (Purba bardhaman) জেলার খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর আবদান কখনই ভুলতে চান না ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দারা। তাই তাঁরাই গ্রামে থাকা বিপ্লবীর পৈতৃক ভিটা ও বসতবাড়ি বহুকাল ধরে আগলে রেখেছেন। এমনকি ওঁয়াড়ি গ্রাম নিবাসী বিপ্লবীর গুনমুগ্ধরা মিলে‘’বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ’ কমিটিও গঠন করেছেন। গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে সেই কমিটির সদস্যরা সারা বছর বটুকেশ্বর দত্তর বন্দনায় মগ্ন থাকেন।
বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর বসতবাড়ি ও ভিটা এখন রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। হয়েছে বিপ্লবীর বসত বাড়ি ও ভিটার সংস্কার কাজ। সেখানে বসানো হয়েছে বিপ্লবীর আবক্ষ মূর্তি। প্রতি বছর বিপ্লবীর জন্মদিবস থেকে শুরু করে দেশের সাধারণতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের দিনে ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দারা বটুকেশ্বর দত্তের জন্ম ভিটায় উপস্থিত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। একইভাবে দেশের ৭৫ তম সাধারণতন্ত দিবসে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বৃহস্পতিবার সমস্ত আয়োজন সেরে ফেলেন বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সদস্যরা।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর নাম। বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের (Bhagat Singh) ভাবশিষ্য হিসাবে পরিচিত বটুকেশ্বর দত্ত। তিনি এবং ভগৎ সিং মিলে ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর বোমা নিক্ষেপ করে ইংরেজ পুলিশ অফিসার স্যাণ্ডারসনকে লাহোরে হত্যা করেন। তারপর থেকে দুই বিপ্লবীকে ধরতে ইংরেজ পুলিশ শুরু করে চিরুনি তল্লাশি। গ্রেপ্তারি এড়াতে ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভগৎ সিংকে সঙ্গে নিয়ে ওঁয়াড়ি গ্রামে চলে আসেন বটুকেশ্বর দত্ত। সেই খবর পেয়ে ইংরেজ পুলিশ ওঁয়াড়ি গ্রামে পৌঁছে বটুকেশ্বর দত্তের বাড়ি ঘিরে ফেলে। তখন ভগৎ সিংকে সঙ্গে নিয়ে বটুকেশ্বর দত্ত প্রতিবেশী নগেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের বাড়ির পাতাল ঘরে আত্মগোপন করেন। দুই বিপ্লবী ১৮ দিন ওই পাতাল ঘরে আত্মগোপন করে থাকেন। পাতাল ঘরে বসেই তাঁরা পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা করেন। এরপরে ফের ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অকুতোভয় এই দুই বিপ্লবী মহিলার ছদ্মবেশে ওঁয়াড়ি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যান। নগেন্দ্রপ্রসাদের উত্তরসূরি প্রণব ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রেখা ঘোঘ জানান, তাঁর শ্বশুরবাড়ির পাতাল ঘরে দুই বিপ্লবীর আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় রোমহর্ষক পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেন। এই কথা তাঁর ঠাকুমা শাশুড়ি পঙ্কজিনী ঘোষের মুখ থেকে শ্বশুরবাড়ির সবাই জানতে পারেন। তিনিও তাঁর স্বামীর কাছ থেকে সেটাই শুনেছেন বলে রেখাদেবী জানান।
দেশের স্বাধীনতার জন্যে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর লড়াই আন্দোলন শুধু মাত্র কয়েকটি কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে দিল্লির কেন্দ্রীয় সংসদ ভবনে বোমা ফাটানোর জন্যও তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। বোমা নিক্ষেপের পর তিনি এবং ভগৎ সিং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে সংসদ ভবন মুখরিত করে তোলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াকু আন্দোলনে শামিল হওয়ার কঠিন মাসুল দিতে হয়েছিল ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধা বটুকেশ্বর দত্তকে। ফাঁসি কাঠে জীবনের ইতি ঘটে ভগৎ সিংয়ের। আর জীবনের দীর্ঘ সময় বটুকেশ্বর দত্তকে কাটাতে হয় কারাগারে। সেখানেও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল ইংরেজ পুলিশের অমানুষিক নির্যাতন।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এহেন দেশ ভক্ত বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্ত কিন্তু যথাযোগ্য মর্যাদাটুকু পাননি। জানা যায়, কোনও সরকারি সাহায্য পাওয়া তো দূরের কথা রুটি রুজি জোগাড়ের জন্য বটুকেশ্বর দত্তকে কখনও সিগারেট এজেন্সির এজেন্ট হিসাবে কাজ করে আবার কখনও পাউরুটি বিক্রি করতে হয়েছে। একমাত্র কন্যা ভারতি এবং স্বামী বটুকেশ্বর দত্তর পাশে দাঁড়াতে স্ত্রী অঞ্জলিদেবী একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও অবহেলার শিকার হন বটুকেশ্বর দত্ত। ১৯৬৪ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে একটা বেড পাওয়ার সৌভাগ্যও তার হয়নি। শেষে ১৯৬৪ সালের ২২ নভেম্বর বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির সবরমাতি হাসপাতালে পৌঁছান। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি আর হয় না। সেইসময়ে ছেলের সহযোদ্ধা বটুকেশ্বর দত্তর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভগৎ সিংয়ের মা বিদ্যাবতী দেবী। শোনা যায়, ভগৎ সিংয়ের মায়ের কোলে মাথা রেখেই ১৯৬৫ সালের ২০ জুলাই বটুকেশ্বর দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মধুসূদন চন্দ্র জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বটুকেশ্বর দত্ত যেমন মর্যাদা পাননি তেমনি বছরের পর বছর ধরে অনাদরেই পড়েছিল বিপ্লবীর বসত বাড়ি ও ভিটা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বটুকেশ্বর দত্তর বসত বাড়ি, ভিটা ও তার লাগোয়া নগেন্দ্রনাথ ঘোষেদের সেই পাতাল ঘর ‘হেরিটেজ’ স্থান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে রাজ্যের পর্যটন দপ্তর বটুকেশ্বর দত্তর জন্মভিটা ও পৈতৃক বাড়ি এবং ওই পাতাল ঘর সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বসত ভিটা সহ মাটির দেওয়াল ও টিনের চালার বাড়ির কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে হয় সংস্কার কাজ। বটুকেশ্বর দত্ত এবং ভখৎ সিংয়ের আবক্ষ মূর্তিও সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এইসব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর বিপ্লবীর কন্যা ভারতি বাগচী একদিন তাঁর বাবার জন্মভিটা ঘুরে দেখে গিয়েছেন। এরপর দেরিতে হলেও ভারতীয় রেল বর্ধমান স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তর নামে।