- আশিস ঘোষ
ভোট এলেই বাতাসে নানারকম সংখ্যা ভাসতে থাকে। এবারও ভাসছে। বলা ভালো, ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪০, ৩৭০, ৪০০ সংখ্যাগুলো ঘুরছে মুখে মুখে। খোরাকজীবী চ্যানেলে, খবরের কাগজে সেসব নিয়ে কাটাকুটি চলছে এখন থেকেই। গোদি মিডিয়ার একরকম হিসেব। বাকিদের আরেকরকম। আর মাসদুয়েক পরেই লোকসভার ভোট। তাই উত্তেজনার আঁচ গনগনে রাখতে উনুন ধরিয়ে বসে আছে সবাই।
এবার বড় মাপের ঢিল ছুড়েছেন খোদ মোদি। ভরা লোকসভায় তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন, বিজেপি একাই পাবে ৩৭০। আর বাকি শরিকদের নিয়ে এনডিএ পাবে ৪০০। অতএব ‘অবকি বার চারশো পার’ স্লোগানে বাজার কাঁপাতে ভক্তরা নেমে পড়ল বলে। কী করে এত নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তিনি তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দে বিরোধীরা। তবে কি সবকিছু আগে থেকেই সেট করা আছে? তবে কি ইভিএমে কারসাজি করা হবে?
এদিকে কংগ্রেসের ওপর বেজায় খাপ্পা বাংলার দিদি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন, আরে, ৪০টা পেয়ে দেখাও আগে। লোপ্পা ক্যাচ ধরে নিয়ে মোদিও ব্যঙ্গের সুরে শুনিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস যেন ৪০ সিটের কম না পায়! এ রাজ্যে আবার বিজেপি কর্মীদের ৩৫ সিটের টার্গেট দিয়ে রেখেছেন মোদি-শা’রা।
চণ্ডীদাসের খুড়োর মতো এই ভবে অতুল কীর্তি রাখার একটা অদম্য তাড়না রয়েছে আমাদের প্রধান সেবকের। তা সে বিশাল মূর্তি হোক, পেল্লায় ভবন, স্টেডিয়াম, মন্দির হোক কিংবা নানা ধরনের চমক। লোকসভার ভোটে এখনও পর্যন্ত রেকর্ড রয়েছে রাজীব গান্ধির। ইন্দিরা হাওয়ায় ১৯৮৪ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪১৪ সিট। সেই রেকর্ড ভাঙতে, না হোক কাছাকাছি যেতে পণ করেছেন তিনি, এমনটাই দিল্লির কানাঘুষো। সে যাই হোক, বিরোধীদের এমন ছন্নছাড়া অবস্থাতেও কিন্তু দৌড়ঝাঁপ কম নেই পদ্ম শিবিরের। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোকে ইডি, সিবিআই লাগিয়ে ব্যতিব্যস্ত করার পাশাপাশি মরিয়া হয়ে এনডিএ জোটে সঙ্গী জোগাড় করতে নেমে পড়েছে তারা। দশ বছরে অকালি, শিবসেনার মতো পুরোনো সঙ্গীরা বিজেপির হাত ছেড়েছে। এখন যত বেশি সম্ভব দল আর সিট কুড়োতে দু’বার ভাবছে না তারা।
প্রশ্ন উঠছে, এতই যদি ৪০০ আসনের অঙ্কে ভরসা থাকে তবে শিবসেনাকে ভেঙে দলবদলু একনাথ শিন্ডেকে একেবারে গলবস্ত্র হয়ে মুখ্যমন্ত্রী করার পর এনসিপি ভেঙে অজিত পাওয়ারকে হাসিমুখে উপমু্খ্যমন্ত্রী করতে হল কেন? দক্ষিণে সিট জোগাড় করতে এআইএডিএমকের ডজনখানেক প্রাক্তন বিধায়ককে দলে নিতে হল কেন? কেন অন্ধ্রে চন্দ্রবাবুর সঙ্গে দোস্তি করতে হচ্ছে? কেন নীতীশ কুমারের হাত আবার ধরতে দু’বার ভাবল না নীতিবাগীশ বিজেপি? কেন ভোটের মুখে ভারতরত্ন দিয়ে দলে টানতে হল চরণ সিংয়ের নাতিকে? কেন মরিয়া হয়ে বৈঠকে বসতে হচ্ছে শিরোমণি অকালি দলের সঙ্গে? এতগুলো প্রশ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছে কোথাও একটা আত্মবিশ্বাসের অভাবের কথাও।
২০১৯ সালে বিজেপি যে ১৩৩টা সিটে হেরেছিল তার অর্ধেকই ছিল দক্ষিণ ভারতে। তাদের সব থেকে বড় লাভ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। ২০১৪ সালে বিজেপির হাতে ছিল ২৮২টা আসন। পাঁচ বছর পর তা বেড়ে হয়েছে ৩০৩। মোদির বাণীমতো ৩৭০ সিট পেতে হলে ৬৭ সিট আরও পেতে হবে। গতবার, ২০১৯ সালে পাঁচটি রাজ্যে একচেটিয়া জিতেছে বিজেপি। বাকি এসেছে ৯ রাজ্য আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে। ৪৩৬ আসনে লড়ে তারা জিতেছিল ৩০৩টিতে। বিজেপি এরাজ্যে পেয়েছিল ১৬টি বাড়তি আসন। সবমিলিয়ে ১০ রাজ্যে বিজেপি পেয়েছিল আগেরবারের তুলনায় বাড়তি ৪৪ সিট। ১০ রাজ্যে হারিয়েছিল ২৩টা। ফলে হরেদরে তাদের আসলে লাভ হয়েছিল ২১ সিট। এবার, বিজেপির বেশি নজর যে ১৩৩টা সিটে তারা লড়ে হেরেছিল, সেগুলো।
হিসেব করলে দেখা যাবে, হারা সিটগুলোর মধ্যে ৭২টিতে তারা আছে দুই নম্বরে। তার ২২টাই এই বাংলায়। আবার এই আসনগুলোর মধ্যে ৫৬টি তারা হেরেছে অকংগ্রেসি আঞ্চলিক দলের কাছে। এগুলোর ভিতরে কংগ্রেসের আসন আছে ১৫টি। শুধু দাক্ষিণাত্য ধরলে বিজেপির অবস্থা বেশ সঙ্গিন। হারা ১৩৩ সিটের মধ্যে ৫৯টা শুধুই দক্ষিণের। তাই এবার মোদির নজরে দক্ষিণের রাজ্যগুলো। এখন থেকেই ঘনঘন সফরে যেতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ভোটের শতাংশের হিসেবে গতবার তার আগেরবারের তুলনায় পদ্ম চিহ্নে ভোট বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। সব থেকে বেশি বেড়েছে ত্রিপুরায়, তারপরই পশ্চিমবঙ্গে।
শুকনো সংখ্যার কচকচি ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে একটা কথা বলাই যায়, ব্র্যান্ড মোদিকে সর্বত্র কড়া চ্যালেঞ্জে ফেলতে আরও একবার ব্যর্থ হতে চলেছে বিরোধীরা। নানা সংখ্যা বাতাসে উড়ছে। কোনটা লাগে দেখা যাক।