Saturday, May 18, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ধনতেরাসের মতো সোনা কেনা হয়

ধনতেরাসের মতো সোনা কেনা হয়

  • সৈয়দ তানভীর নাসরীন

প্যালেস্তাইন কি এইরকম ইদ কখনও দেখেছে? আমরা যে ইদকে চিনি, সেটা মাসভর সংযমের শেষে উদযাপনের, কিন্তু গত ছয় মাস ধরে গাজা থেকে রাফা যে সংযম দেখিয়েছে, তারপর এইবার তারা কতটা উদযাপন করতে পারবে? এইসব প্রশ্ন মাথায় খেলতেই যেটা সবচেয়ে বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় তা হল যে, গোটা বিশ্বের যে বিভাজন, সেই বিভাজনের মাঝে এইবারের ইদ কোন নতুন বার্তা বহন করে আনবে? এবং যদি কোনও নতুন বার্তা আনতে পারে, তাহলে আমি (‘সেল্ফ’) ও অপর (‘আদার’)-এর এই যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বকে তা কতটা অতিক্রম করে যেতে পারবে?

একথা তো স্বীকার করা  ভালো যে, ইদও বদলে গিয়েছে। একটা সময় সলমন খান ইদের সময়টাকে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন তাঁর সিনেমার রিলিজের জন্য। এখন সেমাই থেকে পোশাক, সবকিছুতেই এখন মাল্টিন্যাশনাল ব্র্যান্ডের প্রাবল্য। আমাদের ছোটবেলায় ইদের কেনাকাটা করতে গেলে ছোটখাটো দোকান বা হস্তশিল্পের যে উপস্থিতি ছিল, তা কি এই ২০২৪-এ এসে গ্লোবালাইজেশনের যুগে অনেকটাই বিশ্ব বাজারের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে? সত্যিই তো, এআই-এর যুগে বিশ্বে কোনও কিছুই বা কেন শুধুমাত্র ছোট শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে?

কাজের সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইদ দেখেছি। গত চার বছর ধরে মালদ্বীপে ইদের দিন দেখেছি এক অভিনব উদযাপন। দুপুরের পর থেকেই দ্বীপবাসীরা সমুদ্রের তীরে জড়ো হন, বোডু-বেরু নামক মাদলের ছন্দে নারীপুরুষ একসঙ্গে মেতে ওঠেন গানবাজনা, নাচ এবং রং খেলায়। নব্য মৌলবাদ প্রায়শই এই রং খেলার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়, তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু মানুষের হৃদয় যে উদযাপনের কথা বলে, উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে যে সাংস্কৃতিক বিনিময় তৈরি হয়, তাকে ‘ব্যান’ করার ক্ষমতা কার আছে? বাংলাদেশে দেখেছি, ইদ মানেই শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরা, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটানো। ইদানীং আমাদের রাজ্যেও ইদের সেই ধারাটা চোখে পড়ে। ইদের সময় হাওড়া-সাঁতরাগাছি-শালিমার হয়ে দলে দলে মানুষ বীরভূম-মুর্শিদাবাদ-মালদায় ফেরেন। এঁরা হয়তো দেশের অন্য কোনও প্রান্তে কাজ করেন, ‘বৎসরের পরে, ফিরে আসে যে যাহার আপনার ঘরে’।

পুজোয় ঠাকুর দেখা থাকে, কিন্তু ইদে সেই অর্থে কোনও নির্দিষ্ট কাজ নেই। তাই ইদ মানেই ‘সোশ্যালাইজেশন’, সামাজিক বিনিময়। নমাজের শেষে একে অপরের বাড়ি যাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা বা উপহার বিনিময়। এই সোশ্যালাইজেশনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। বিভিন্ন স্তরে ক্রিয়াশীল উভয় তরফের সাম্প্রদায়িকতা যতই দূরত্ব বাড়ানোর সচেতন প্রয়াস করেছে,  উলটোদিকে ততটাই সহৃদয় প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসেছেন এই ‘সেল্ফ অ্যান্ড দ্য আদার’-এর দ্বন্দ্ব ভাঙতে। ইদের কোলাকুলিতে সব বিভেদ ঘুচে গিয়েছে।

সত্তার সংকট, বা তার আশঙ্কা যদি মুসলমানদের ঘেটোয়াইজেশনের দিকে ঠেলে দিয়ে থাকে, তাহলে সেই ঘেটোয়াইজেশনকে ভাঙার সচেতন প্রয়াসও মুসলমান এবং তার প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মধ্যেও অবশ্যই বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, লন্ডনে বা আমেরিকায় দেখেছি ঘেটোয়াইজেশনকে ভেঙে ইদ উদযাপনের ছবি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরেও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ঘেটোকে অতিক্রম করে, নাগরিকরা একে অপরের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখেছি এই রমজানের মাসটায় মহিলারা নিয়মিত মসজিদে যান। তাঁদের অবশ্য আলাদা জমায়েত বা জামাতের স্থান থাকে। ভারতবর্ষে সেই উদ্যোগ এখনও জোরালো নয়, পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই। মাঝে মাঝে মুসলমান মহিলাদেরও সামনে এনে ইদের জামাত করার কিছু প্রয়াস হয়। কখনও তা সফল হয়েছে, কখনও আবার তা মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মহিলাদের আর  বেশিকাল  ইদের দিনেও গৃহকর্মের ছকে বেঁধে, অন্দরমহলে আটকে রাখা যাবে না।

সেই কবে সুচিত্রা ভট্টাচার্য পুজোর প্রেম নিয়ে লিখতে গিয়ে ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার সেই গানটাকে অনুসরণ করে বলেছিলেন, ‘ড্রেস, ডাইন অ্যান্ড ফ্রিক আউট’। সত্যিই তো, পুজো মানে খাও, ভালো পোশাক পরে ঘোরো এবং রোমান্সের সমুদ্রে ডুব দাও। আমাদের ছোটবেলায় কতজনকেই তো দেখেছি পুজোয় প্রেমে পড়তে! তাহলে কি ইদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে সেই পেলব রোমান্টিকতা? যদি রাজেন্দ্র কুমার আর সাধনার ‘মেরে মেহেবুব’-এর কথা মনে রাখেন, তাহলে হয়তো বুঝবেন এই নতুন চাঁদ দেখা এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেলব রোমান্টিকতা, আজও তরুণ প্রজন্মকে কেন আকর্ষণ করে! আজকের পৃথিবীতে, ইদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও নতুন নতুন সিনেমা, নতুন নতুন গান। সেই রোমান্স নতুন জীবনের ইঙ্গিত দেয়, নতুন পৃথিবীর কথাও কি বলে? হয়তো যাঁরা ইদের সময় প্রেমে পড়েন এবং নতুন ইনিংস শুরু করার কথা ভাবেন, তাঁদের মধ্যে একটি নতুন পৃথিবী গড়ারও স্বপ্ন থাকে।

ইদুলফিতরের সঙ্গে একটা সামাজিক কল্যাণের বিষয় জড়িয়ে আছে। যাঁরা আর্থিক সংগতিসম্পন্ন, তাঁদের উপার্জনের একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘ফিতরা’ হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের দান করা হয়। এই যে ‘ফিতরা’র সামাজিক কর্তব্য, যাকে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ বলে মনে করা হয়, সেটাই ইদুলফিতরকে এক গভীর ব্যাপ্তি দিয়েছে। আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে ইসলাম যে সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন আজও ইদের আনন্দে ফল্গুধারার মতো বয়ে যায়। এই যে সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিক ন্যায়, সামাজিক মেলবন্ধনকে আরও শক্তিশালী করা, এটাই ইদুলফিতরের প্রধান বার্তা।

আমার ছোটবেলা যে মফসসল শহরে কেটেছে, সেখান থেকে নিউ ইয়র্ক কিংবা ওয়াশিংটন, ঢাকা কিংবা মালে অথবা আলমাটিতে পৌঁছে দেখেছি যে, ইদ আজ যথার্থই একটা বিশ্বজনীন ব্যাপার, বদলে দেওয়ার তাগিদে একটা গ্লোবাল আইডেন্টিটি পেয়ে গিয়েছে। সেই গ্লোবাল আইডেন্টিটির সঙ্গে এসেছে ব্র্যান্ড, এসেছে বিজ্ঞাপন। ছোট শহরের মলগুলো এখন ঢেকে যায় ইদ সংক্রান্ত বিশেষ বিজ্ঞাপনে, থাকে সিনেমার নতুন ঘোষণা। ঠিক যেমন ওয়াশিংটন কিংবা নিউ ইয়র্কে ইদের সময় যেসব কোম্পানি বাজার দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে হয়তো অধিকাংশ কোম্পানি ইহুদি মালিকানাধীন। প্যালেস্তাইন নিয়ে যে বিভাজন, এমনকি পশ্চিমের দেশেও যে বিভাজন, সেই বিভাজনকে অতিক্রম করে বহুজাতিকের ইদের বাজার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়াটা কীসের ইঙ্গিত দেয়? সেটা কি শুধুই পুঁজির লক্ষ্য, নাকি কোথাও সামাজিক যোগাযোগকেও সূচিত করে?

ইদের বাজার ধরতে পুঁজির এই এগিয়ে আসার কারণে এখন সোনার দোকানগুলোয় ইদের সময় কেনাকাটার জন্য ভিড়। আমাদের ছোটবেলায় আমরা জানতাম না যে, ধনতেরাসের মতো ইদেও সোনা কেনা হয়! এই যে ব্র্যান্ডের গ্লোবালাইজেশন, এই যে ব্র্যান্ডের বিকাশ, সেটাই আজকের ইদকে একটা অন্যরকম চেহারা দিয়েছে। এই চেহারার বিভিন্ন পরত দেখতে দেখতে ভাবি, তাহলে কি মাঝখানের প্রাচীরটা কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে? না, বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে? সেই প্রহেলিকা রহস্য সমাধান হয় না। এর মধ্যেই দেখি বামপন্থীরাও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে নির্বাচনি প্রচার করছেন। যদি সেই হাতে গড়া রুটি আর আলুচচ্চড়ি খেয়ে কমরেডদের বাড়ি বাড়ি ঘোরার বদলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আজ সাম্যবাদের কথা বলে, তাহলে কে জানে সামনের কোন ইদে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের কোন বাণী শোনাবে? সে বাণী সাম্যের হতে পারে, সে বাণী বিভেদের বেড়াকে ভেঙে দেওয়ার হতে পারে, সে বাণী অনেক নতুন পৃথিবীর সূচনা করতে পারে, নাকি বিভেদকে আরও বাড়িয়ে তুলবে?

(লেখক অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

উৎসব কই, বড় অসহ্য নির্বাচনের পরিবেশটা

0
গৌতম সরকার দিন যে আমার কাটে না রে...। কী যে যন্ত্রণা! কোথাও ভোট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনি বিধি বলবৎ। যার গেরোয় স্তব্ধ সবকিছু। যেখানে ভোট...

যে শালিক মরে যায় কুয়াশায়, সে তো আর…

0
দ্যুতিমান ভট্টাচার্য সকালে এক শালিক দেখা মানেই বুক দুরুদুরু! এই রে দিনটা খারাপ হতে চলেছে! বহু মানুষই সযত্নে এই কুসংস্কার মনে লালিত করেন। আবার...

আবেগের ভক্তিরস বনাম দারিদ্র্য

0
রূপায়ণ ভট্টাচার্য মন্দিরের মতো দেখতে রাজকীয় অযোধ্যা রেলস্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে একটি কাঠবেড়ালির চমৎকার স্থাপত্য রয়েছে। রামায়ণের সেতুবন্ধনের সেই বহু আলোচিত কাঠবেড়ালিকে...

Supreme court | উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতি বরদাস্ত নয়, বোসকে কড়া বার্তা সুপ্রিম কোর্টের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজনীতি বরদাস্ত নয়। স্পষ্ট জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। বেশ কয়েকমাস ধরেই রাজ্যের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ...

Gang rape case | চলন্ত ট্রেনে গণধর্ষণের শিকার মডেল! প্রায় ২ মাস পর অভিযোগ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চলন্ত ট্রেনে নেশার জিনিস খাইয়ে এক মডেলকে গণধর্ষণের (Gang rape case) অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ৩১ বছরের মধ্যপ্রদেশের (Madhya Pradesh)...

Most Popular