- ইমানুল হক
১
‘ইদ’ একটি আরবি শব্দ। ‘ইদ’ না ‘ঈদ’ কোনটি সঠিক উচ্চারণ বা বানান সে নিয়ে বাংলাদেশে কিছুদিন আগে তুলকালাম হয়েছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনীষা ব্যক্তিত্ব বৈয়াকরণদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, বাঙালির জিভে দীর্ঘ উচ্চারণ নেই। অতএব ইদ। বিপক্ষের যুক্তি, ঈদ লিখে এসেছি। ঈদ-ই লিখব। এখনও অনেকেই তাই লিখছেন। সমস্যা হচ্ছে, সংস্কৃত বানান হলে আমরা ট্যাঁ-ফোঁ করি না। বলি, তৎসম শব্দ। বানান অবিকৃত থাকতে হবেই। ওঁদের কে বোঝাবে, সুতনুকা শব্দটি পৃথক পৃথক শিলালিপিতে পৃথক পৃথক বানানে আছে। সংস্কৃতেও। সুতনুকা, শুতনুকা, এবং বিস্ময়করভাবে, ষুতনুকা।
মূল রামায়ণে রামের মায়ের নাম কৌশল্যা নয় কৌসল্যা লেখা। আসল কথা এই, সব জাতির একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। বাঙালির তো আছেই বহুল পরিমাণে। বাঙালির ইদ তাই একটু হলেও আলাদা। আরবি ‘ইদ’ মানে আনন্দ খুশির উৎসব।
হজরত মহম্মদ মদিনায় গিয়ে দেখেন, মদিনাবাসীরা দুটি উৎসব উদযাপন করেন। শরতে মিহিরজান, বসন্তে নওরোজ। নওরোজ পারসিক নববর্ষ উৎসব। এতে গান বাজনা আনন্দ উৎসব চলে। হজরত মহম্মদ উৎসব প্রচলন করলেন। কিন্তু উপবাসের কষ্ট বেয়ে আসে প্রথম উৎসব।
২
হজরত মহম্মদ সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী ছিলেন। অগ্নিপূজক পারসিকদের সমান সম্মানের সঙ্গে উপাসনার অধিকার দিয়েছেন। আর এখন কিছু মৌলবাদী অন্য ধর্মের উপাসনায় বাধা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে।
তিনি মনে করতেন, তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। কিন্তু যিশু মুসাদের বলা হত ঈশ্বরের পুত্র। আদম থেকে যিশু পর্যন্ত সব ‘মহাপুরুষ’-কে তিনি নবি বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে স্বীকার করেছেন। এবং বলেছেন, তিনিই ঈশ্বরের শেষ প্রতিনিধি।
ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের যা কিছু ভালো তা নিয়েছেন। গ্রহণ করেছেন আরব বেদুইনদের কাব্যিক ভাষা। কোরান পৃথিবীর প্রথম লিখিত গদ্যগ্রন্থ। এবং তা অসম্ভব কাব্যিক ও তত্ত্বচেতনাময়। তবে অন্ধরা সব কোরানে আছে বলে বিপত্তি বাড়ান। যেমন একদল বলেন, সব বেদে আছে।
ইহুদিরা পালন করেন সিয়াম। ইহুদিদের এই প্রথা নিয়েছেন হজরত মহম্মদ। সিয়াম মানে সংযম। উপবাস তার একটা প্রকাশ। আসল কথা আত্মসংযম। সর্ব অর্থে। মিথ্যা কথা না বলা, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা না করা, খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো, পরচর্চা পরনিন্দা কোনও সময়েই না করা, উপবাস অবস্থায় যৌন সম্পর্কে বিরত থাকা, অসূয়া বিদ্বেষ পোষণ না করা, সুদ না নেওয়া, নেশা না করা ইত্যাদি।
নবিজি বলেছেন, এর একটাও যদি মানতে না পারো তবে রোজা রেখো না। অর্থাৎ শুধু উপবাস করাই রোজা নয়। সম্পূর্ণ আত্মসংযমের নাম রোজা। রোজার শেষে আসে ইদ। আসল নাম ইদুলফিতর। ২৯ বা ৩০ দিন উপবাসের শেষে ইদুলফিতর। আরেকটি ইদ-উল-আযহা। দ্বিতীয়টি কোরবানি ইদ নামে বেশি প্রচলিত।
ইদের দিন শুধু নমাজ পড়লেই হবে না নিজের রোজগারের ২.৫% দান করতে হবে। যার নাম জাকাত। এটি স্বেচ্ছায় করতে হবে। এবং সেই দান এমন হবে যেন, ডান হাতের দান বাম হাত জানতে না পারে। হারাম এবং হালাল কথাটি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। হারাম মানে অবৈধভাবে রোজগারে ইদ পালন দানধ্যানে কোনও পুণ্য বা নেকি নাই। যতই উপবাস করো। বৈধভাবে সৎপথে উপার্জিত অর্থই কেবল আল্লাহর পছন্দ। অকারণ বৈভব দেখানো জাঁকজমক করা, তোরণ করা, আলোকসজ্জা ইসলামের আদর্শবিরোধী। আসল কথা দানধ্যান আত্মসংযম ও আত্মউন্মোচন।
কিন্তু অনেকেই রোজা রাখেন, সিয়াম বা সংযম পালন করেন কতজন? এই সংযম মানে জিভ, কান, নাক চোখের সংযম। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না- খারাপ দেখবে না, খারাপ বলবে না, খারাপ শুনবে না। এটা আসলে ইসলামের কথা। পরনিন্দা পরচর্চা অর্থাৎ গিবত হারাম। সুদ নেওয়া হারাম, অন্যের অনিষ্ট চিন্তা বা বিদ্বেষ ভাব বা হিংসা পুষে রাখা হারাম। রাগ হারাম/ চুরি মিথ্যা কথা বলা মদখাওয়া ঘুষ খাওয়া–সব হারাম। এর কোনও একটি করলেই রোজা নষ্ট।
উপবাস বা রোজা চালুর পিছনে শরীররক্ষার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও আছে উপবাসী বা ক্ষুধার্তের যন্ত্রণা অনুভব করানোর ইচ্ছা।
এখন প্রশ্ন, কতজন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত এটা বুঝছেন। ইফতার এখন দেখনদারের বিষয় হয়ে গেছে। কিন্তু সবার কাছে তা নয়। দুর্গাপুজোয় যেমন সব হিন্দুর নতুন জামা জোটে না, সবার পুজোয় ঘোরা হয় না, ইদেও সবার নতুন জামা জোটে না। ইফতারে ভালো খাবার জোটে না। অবশ্য রোজা রাখতেই পারেন ক’জন? নিত্য যাঁদের অর্ধাহার, তাঁদের কাছে রোজা বিলাস।
কিন্তু ইদ সবার। সেমাই লাচ্ছা কিনে একটু মাংসভাত ইচ্ছেপূরণের দিন। তবে ইদ মানেই বিরিয়ানি নয়। ইদে বিরিয়ানি আমি গ্রামে দেখিনি। এমনকি মেটিয়াবুরুজেও ইদে আগে বিরিয়ানি হত না। এটা কিছুটা সামাজিক মাধ্যম, কিছুটা হিন্দু সম্প্রদায়ের বন্ধুদের আবদার। কিছুটা উত্তর ভারতের প্রভাব। বাঙালির ইদে বিরিয়ানি ছিল না, কোলাকুলি ছিল খোলাখুলি। এখন মন খুলে কোলাকুলি আউট বিরিয়ানি ইন।
৩
ইদ মানে খুশি। সেমাই লাচ্ছা মোটা সেমাই দুপুরে ভাত মাংস। ইদে বহুকাল গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না। ২০১১ থেকেই বন্ধ। বকরিদে যাই। সেদিনও বিরিয়ানি দেখি না, কোনও বাড়িতে। সাদা ভাতের চেয়ে নানা ধরনের মাংস খাওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব আর কিছু নেই। বকরিদে তো অঢেল মাংস। মাংস পোড়া, কাবাব, কোপ্তা, দোপেঁয়াজা, কলজে ভুনা, চাপ, কষা মাংস। ইদে এতরকম মাংস হয় না। ইদে তো মাংস কিনতে হয় দোকান থেকে সারি বেঁধে। এবার তো ইদের আগের দিন, একটা দোকানে মাংসের দাম কিলো পিছু ১০০ টাকা বেশি নিল।
ইদের আগে এক মাস রোজা রাখা কঠিন কাজ। কী করে আমার বেশ কিছু চেনা মানুষ করেন, দেখে অবাক হয়ে যাই। আগে রোজা রাখতেন বড় জোর ৫% পুরুষ। মহিলারা ১০-২০% রাখতেন। এখন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মানুষের মধ্যে লোভ বেড়েছে, অসততা বেড়েছে আবার ধর্মও বাড়ছে।
৪
ইদ মানে মন খারাপও ছিল। আশ্বিন কার্তিক মাসে ইদ বকরিদ পড়লে নতুন জামা বা টুপি হত না। পৌষ মাঘ ফাল্গুনে ইদ/ বকরিদ পড়লে তো সোনায় সোহাগা। বাবাদের মন ভালো, মায়েদেরও। তখন গরিব বড়লোক মধ্যবিত্ত সবাই কম বেশি নতুন জামাকাপড় কিনতে পারতেন। নাহলে চাকরিজীবী ছাড়া বাকিদের মুশকিল।
তখন তো জামাকাপড় কেনার সময় আশপাশের লোকজন কিনতে পারছেন কি না সেটাও বাবারা খেয়াল রাখতেন। অন্যরা নতুন পোশাক পরছে না, তোমরা পরবে? এ কীরকম কথা? সমাজে মানবিকতা অনেক বেশি ছিল। চক্ষুলজ্জা এবং শুভবোধ। এখন দেখানেপনার যুগ।
৫
অনেকে ইদানীং বলেন, ইদ কেন সর্বজনীন হবে না। আমি এটা চাই না। পবিত্র হজরত মুহম্মদ উৎসবকে দেখতেন দানধ্যানের মধ্যে দিয়ে পালন। এখন ইদ যদি আরেকটা ধর্মীয় উৎসবের মতো নিজের পোশাক, খাওয়াদাওয়া, আলোকসজ্জা, মাইক বাজানো, বড় বড় আলোকময় তোরণ, ব্যানারের ব্যাপার হয়ে যায়, সাড়ে সর্বনাশ।
মুসলমানদের উৎসব মানে অন্যের সুখ-দুঃখের খেয়াল রাখা। নিজে খাওয়া নয়। ইদ মহরম শবেবরাত সবেতেই আমরা বড় বড় খাঞ্চা করে ভালো ভালো খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে ঝড় বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। কেউ চাইতে আসবেন — এটা লজ্জা। যাঁর কম আছে তাঁকে দিয়ে আসবেন তুলনায় বেশি থাকা মানুষের দল। এটাই তো আসল খুশি, আনন্দ, উৎসব। আসল ইদ।
ইদ মানে খাবারদাবার পোশাকের সেলফি নয়, অন্যের খেয়াল রাখা। যত্ন নেওয়া। জাকাত ফিতরা দেওয়া। দানধ্যান করা। খুশিকে ভাগ করে নেওয়া। এ স্বাদের ভাগ হবে না নয়। ইদের স্লোগান, সব স্বাদের ভাগ হয়, ভাগ করলে স্বাদ বেড়ে যায়। ইদের স্বাদের ভাগ নিন বন্ধুরা।
(লেখক অধ্যাপক ও সমাজকর্মী)