Tuesday, May 21, 2024
Homeকলামভোট, বদহজম ও নেতাদের হজমি গুলি

ভোট, বদহজম ও নেতাদের হজমি গুলি

 

  • শুভ সরকার

ছোটবেলায় একটা বিজ্ঞাপন দেখতাম টিভিতে। বেশ জনপ্রিয় একটা হজমি গুলির ব্র্যান্ড ছিল সেসময়। বিজ্ঞাপনটা সেটার। দেখানো হত, কোনও একজন দলবল পাকিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলছেন। রাজাউজির মারছেন। অনেকটা টেনিদা, ঘনাদা স্টাইলে। তাঁর কথাবার্তার মাঝে হঠাৎ খুঁতখুঁত করে কেউ একজন আপত্তি জানিয়ে বলে, এ কথাটা ঠিক হজম হল না। তখনই টিভির পর্দায় ভেসে উঠত সেই ব্র্যান্ডের নাম। অর্থাৎ, আপনি যা খুশি হজম করতে চান, যখন খুশি হজম করতে চান, সব হয়ে যাবে, যদি আপনি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের এই হজমি গুলি খান।

সেই ব্র্যান্ডটি বোধহয় এখনও রয়েছে। তবে তার বিজ্ঞাপন সেভাবে আর চোখে পড়ে না। তা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ুক, আর না পড়ুক, হজমি গুলির কথা ভোটের সময় বড্ড মনে পড়ে যায়। কত কিছুই না হজম করতে হয় বেচারা নেতাদের। ওই যে কথায় বলে, কিল খেয়ে কিল হজম করা। ভোটের কিল হজম করা বোধহয় তার থেকেও ভয়ানক। জন বারলার কথাই ধরুন না। যাঁরা বারলাকে অতটা চেনেন না, তাঁদের একটু ধরতাই দিই।

গত লোকসভা ভোটে আলিপুরদুয়ার আসনে অনেকটা মার্জিনে জিতে সাংসদ হন বারলা। মন্ত্রীও হন। সেই বারলাকে নিয়ে এবার আগে থেকেই জল্পনা চলছিল যে, তিনি পরপর দু’বার টিকিট নাও পেতে পারেন। হলও তাই। সবার আগে বিজেপি এ রাজ্যের যে কয়টি কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা করে, তার মধ্যে ছিল আলিপুরদুয়ার। সেখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বারলা এবার আর টিকিট পাচ্ছেন না। ব্যাস, মেজাজ সপ্তমে চড়ে বারলার। তাঁর জায়গায় আলিপুরদুয়ার আসনে যিনি বিজেপির টিকিট পেলেন, সেই মনোজ টিগ্গার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেন। অসৎ উপায়ে মনোজের কী কী সম্পত্তি রয়েছে, সাংবাদিকদের ডেকে ডেকে তার খতিয়ান দিতে থাকেন।

সেসব কথা তখন মনোজকে চুপচাপ হজম করতে হয়েছে। পালটা কিছু বলেননি কেন? রাজনীতিতে ধুরন্ধর মনোজ বিলক্ষণ জানেন, চা বলয়ে বারলার সাংগঠনিক শক্তি কতখানি। আলিপুরদুয়ারের মতো চা বাগান অধ্যুষিত কেন্দ্রে ভোটে চা বলয় বাদ দিয়ে জয়ের কথা ভাবাই যায় না। তাই বারলা যখন তাঁর সম্পর্কে যা নয় তা-ই বলছিলেন, তখন মনোজ সব হজম করে ঘাপটি মেরে বসেছিলেন।

তাঁর সেই ধৈর্য ধরার ফল ফলেছে। দলের অন্দরেই নানাভাবে বারলাকে এমন টাইট দেওয়া হয়েছে যে, তিনি বাধ্য হয়েছেন মনোজের হাত ধরে প্রচারে নামতে। আক্ষরিক অর্থেই হাতে হাত। বাইরে মনোজকে ভাই ডেকে বুকে জড়ালেও প্রশ্ন হল, আদতে বারলা কি তাঁর পুরোনো কথা, পুরোনো রাগ হজম করেছেন? ভেতরে ভেতরে কী চাল চেলেছেন, তা ভোটের ফল বের না হলে বোঝা যাবে না ঠিকই, কিন্তু শেষপর্যন্ত তো তাঁকে বলতেই হয়েছে, মনোজ আমার ভাই। তিন সপ্তাহ আগে বলা সব কটু কথা হজম করতে হয়েছে। এ-ও রাজনীতি আর ভোট নামক ডাবল অ্যাকশন হজমি গুলির কামাল।

এমন উদাহরণ আরও আছে। বারলার মতো অত বড়মাপের না হলেও আলিপুরদুয়ারের আরেক নেতা লুইস কুজুর কিছুদিন আগে অবধি তৃণমূলে ছিলেন। তারও আগে বিজেপিতে ছিলেন। এখন আবার তিনি বিজেপির নেতা। আগে যখন বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছিলেন, পুরোনো দলের প্রতি বিষোদগার করেই গিয়েছিলেন। আবার যখন বিজেপিতে ফিরলেন, পুরোনো কথা হজম করে তাঁকে বলতে হল, তৃণমূল চাপ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাঁকে দলবদল করতে বাধ্য করেছিল।

সেই ভয়টা যে কাটল কীসে, সেটা অবশ্য খোলসা করেননি। মনে হয়, মাসখানেক আগে তৃণমূলের আলিপুরদুয়ার-২ ব্লকের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়াটাই ছিল তাঁর ভয় কাটিয়ে ওঠার আগুনে ধুনো। কিন্তু তৃণমূলের হয়ে এতদিন বিজেপির নামে যা যা খারাপ কথা এতদিন বলেছেন, সেসব তাঁকে হজম করতে হল। আরেকজন জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটার অমরনাথ ঝা। শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে সদ্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। দিদির সৈনিক থেকে মোদির সৈনিক হয়েছেন। ‘মোদির বঞ্চনা’, ‘মোদির লোকঠকানো’ বলে এতদিন যা যা বলে এসেছেন, সেসব তাঁর এখন যত দ্রুত হজম হয়, তত মঙ্গল।

উত্তর ছেড়ে দক্ষিণে তাকানো যাক। অর্জুন সিংয়ের কথা আসবেই। মৌমাছির মতো অর্জুন কখন যে কোন ফুলে বসছেন, সেটা মনে রাখতে গেলে খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসতে হবে। বর্তমানে বিজেপির হয়ে অর্জুন তৃণমূলের দুর্নাম করছেন। এতদিন তৃণমূলে থেকে বিজেপির যত বদনাম করেছেন, সেসব হজম করছেন। এসব পালটিবাজি তাঁর ঠোঁটের ডগায় থাকে। এর আগে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে বলা সব কথা হজম করতে হয়েছিল।

বড় মন্ত্রী, মেজো বিধায়ক, মাঝারি নেতা, ছোট পার্টি-গুন্ডা, রাজনীতিতে হাত পাকানোর সঙ্গে সঙ্গে সবাই হজমের ক্লাস করেন নিয়মিত। তাঁরা রাজনীতিতে হাত পাকান আর হজমে পাকান পাকস্থলী। যে মুখে সকালে এই ফুলের গুণগান, বিকেলে দলবদলের পর সেই মুখে সেই ফুলের মুণ্ডুপাত। সকালে যে বিরোধী ছিল, তার দিকে ছোড়া থুতু বিকেলে বন্ধু হয়ে যাওয়ার পর টুক করে গিলে ফেলতে হয়। এসব করা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রতিভা লাগে। আমাদের নেতারা প্রতিভাবান।

আর আমরা, আমআদমি, আমরা কী করি? নেতারা যে গোটা গণতন্ত্র, প্রশাসন, সুশাসন, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি গপাগপ খেয়ে হজম করে ফেলছেন, আমরা তার চোয়া ঢেঁকুর তুলি। খবরের কাগজের ভাষায় সেটাই ভোটদান। ভোটারের পেটে সব সয়। আমাদের অবশ্য হজমি গুলি লাগে না।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Dinhata | সীমান্তে গোরু পাচার! দিনহাটায় বিএসএফের গুলিতে জখম ১

0
দিনহাটা: বিএসএফের (BSF) গুলিতে জখম হলেন এক গোরু পাচারকারী। ঘটনাটি ঘটেছে দিনহাটার (Dinhata) গিতালদহ সীমান্ত এলাকায়। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই পাচারকারী। গোটা ঘটনায় চাঞ্চল্য...

Ebrahim Raisi | রাইসির মৃত্যুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্র! বিতর্কের মাঝেই মুখ খুলল ইজরায়েল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: রবিবার চপার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ইরানের (Iran) প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির (Ebrahim Raisi)। একই সঙ্গে নিহত হয়েছেন সেদেশের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদোল্লাহিয়ানও।...

Abhijit Gangopadhyay | মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুমন্তব্য! অভিজিতের প্রচারে ২৪ ঘণ্টার নিষেধাজ্ঞা জারি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সম্পর্কে কুমন্তব্য! তমলুকের বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Abhijit Gangopadhyay) প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি...

Srijan Bhattacharya | সুজন চক্রবর্তীর পর সৃজন ভট্টাচার্য! যাদবপুরের বাম প্রার্থীর প্রচারে ইটবৃষ্টি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য (CPIM Srijan Bhattacharya) প্রচারে হামলা। মঙ্গলবার পঞ্চসায়র এলাকায় প্রচার (Election campaign) করছিলেন সৃজন। সেখানে তাঁর...

Teesta River | লোনাক বিপর্যয়ে পলি পড়ে তিস্তাগর্ভ দেড় মিটার উঁচু, বিপদের শঙ্কা

0
পূর্ণেন্দু সরকার, জলপাইগুড়ি: গত বছর সিকিম বিপর্যয়ে (Sikkim Disaster) সমতলে তিস্তাগর্ভ দেড় মিটার উঁচু হয়েছে। আসন্ন বর্ষায় ২০২৩-এর মতো পাহাড় ও সমতলে একনাগাড়ে বৃষ্টি...

Most Popular