Wednesday, June 26, 2024
Homeকলামএই ভোট ঠিক করবে কোন পথে যাবে দেশ

এই ভোট ঠিক করবে কোন পথে যাবে দেশ

রন্তিদেব সেনগুপ্ত

সাত দফার লোকসভা নির্বাচন এখন একদম শেষ পর্যায়ে। এবারের এই লোকসভা ভোট অতীতের নির্বাচনগুলির থেকে ধারে ভারে এবং গুরুত্বে অনেকখানিই আলাদা। গুরুত্ব এবং তাৎপর্যের দিক দিয়ে এবারের নির্বাচনকে ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করা চলে।

১৯৭৭-এর সেই নির্বাচনটি ছিল ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার রাজনীতির বিরুদ্ধ জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে বিরোধীদের সংঘবদ্ধ লড়াই সফল হয় কি না, তার একটি পরীক্ষা। সেই নির্বাচনেই প্রথম দিল্লিতে জোট সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করে জোটের শক্তি প্রমাণ করে দিয়েছিল। তারপর অনেকগুলি নির্বাচন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। অনেক উত্থানপতনও দেখেছে সবাই। তবু, ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনটি ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই কারণেই যে, ওই নির্বাচন জোট রাজনীতির ভাবনাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল।

এবারের লোকসভা ভোটও কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্টে এনে দাঁড় করিয়েছে দেশকে। ভবিষ্যতে ভারতীয় রাজনীতি কোন পথে ধাবিত হবে, তা পরিষ্কার হবে এবার ভোটের ফলের ওপর। ১৯৭৭-এর সঙ্গে এবারের ভোটের একটি বিষয়ে অন্তত মিল রয়েছে। এবারের ভোটে এতদিন ধরে নিজেদের ভিতর বিবদমান বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপির মতো অর্থে, ক্ষমতায় এবং সাংগঠনিক শক্তিতে ভরপুর এক শাসকের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে। যেমন, ’৭৭-এ ইন্দিরার শক্তিশালী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছিল জয়প্রকাশের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের জনতা পার্টি। আবার একটি অমিলও রয়েছে। ওই জনতা পার্টিতে শামিল হয়েছিল যে জনসংঘ, নাম বদলে আজ তারাই বিজেপি রূপে কেন্দ্রের ক্ষমতায়। উলটোদিকে, সেদিন যারা তার বিরোধী ছিল আজ তাদের সঙ্গেই ইন্ডিয়া জোট গড়ে কংগ্রেস লড়তে নেমেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। মাঝের পাঁচটি দশকে রাজনীতির খাত সম্পূর্ণ অন্যদিকে বয়ে গিয়েছে।

ফিরে আসা যাক এবারের ভোটে। এবারের ভোট হচ্ছে মোটামুটি দুটি বিষয়ের উপর দাঁড়িয়ে। এক, হিন্দুত্ব এবং দুই, শাসকের স্বৈরাচার এবং দুর্নীতির বিরোধিতা। শাসক বিজেপি প্রথম থেকেই এবারের ভোটটিকে তাদের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের লড়াইয়ে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এই চেষ্টা বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গত কয়েকবছর ধরেই পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে গিয়েছে।

বিজেপি-আরএসএসের এই রাজনৈতিক হিন্দুত্বে মূলত ত্রিমুখী প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক, এদেশে হিন্দুরা সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। দুই, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ( মূলত মুসলমান) এই দেশে যাবতীয় সমস্যার মূল এবং তিন, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করলেই হিন্দুরা নিরাপদে এই দেশটিতে থাকতে পারবে।

সামনের বছর আরএসএস একশো বছরে পদার্পণ করছে। গত একশো বছরে আরএসএস নিরলসভাবে এই ত্রিমুখী প্রচার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চালিয়ে গিয়েছে। দশ বছর কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এই প্রচারধারাকেই নানাবিধ সুকৌশলী উপায়ে দেশের মানুষের মনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। একথাও অস্বীকার করা যাবে না, বিজেপি আরএসএস এই কাজটিতে সফলও হয়েছে। একটা বড় অংশের মানুষের ভিতর এই প্রচারের সাফল্য পেয়েছে তারা। বিজেপির হিন্দুত্ববাদের পক্ষে একটা বড় জনসমর্থন গড়ে উঠেছে দেশে। এই ভোটব্যাংকই বিজেপির বড় ভরসা।

এই ভোটব্যাংকটিকে আরও বেশি চাঙ্গা করতে এবারের নির্বাচনি প্রচারে উগ্র হিন্দুত্বের কৌশল নিতেও বিজেপি পিছুপা হয়নি। ভোটের ঠিক মুখে অযোধ্যায় অর্ধসমাপ্ত রাম মন্দির উদ্বোধন করে হিন্দুত্ব আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা থেকে, ভোট প্রচারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি কটূক্তি এবং হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মরিয়া প্রচেষ্টা প্রমাণ করেছে, বিজেপি আরএসএস এই ভোটটা হিন্দু কার্ডেই খেলতে চাইছে।

এখানে এটাও বলা দরকার, এরকম খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য পূর্ববর্তী কোনও প্রধানমন্ত্রীই কখনও রাখেননি। এমনকি বিজেপির ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও নন। কিন্তু ভোট প্রচারে এই ভাষণ নীতিবিরুদ্ধ জেনেও নরেন্দ্র মোদি এই ভাষণই দিয়েছেন। কারণ, এবার ভোটে এটাই তাঁর রণকৌশল। হিন্দুত্বের জোয়ারে ভোটে জিতে আসা।

উলটোদিকে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, আপ, শারদ পাওয়ারের দলের মতো বিরোধীরা। এর আগের নির্বাচনগুলিতে দেখা গিয়েছে বিজেপির হিন্দুত্বের পাতা ফাঁদে এই বিরোধীরা অনায়াসে পা দিয়েছে এবং শেষপর্যন্ত বিজেপি সেই লড়াইকে হিন্দু বনাম হিন্দু বিরোধীর লড়াইয়ের চেহারা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে। এবারের নির্বাচনে বিরোধীরা সচেতনভাবেই বিজেপির এই পাতা ফাঁদটিতে পা দেয়নি। বরং তারা বিজেপির বিরুদ্ধে বিভাজনের রাজনীতি, কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করা ইলেক্টোরাল বন্ড, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, সরকারি এজেন্সিগুলিকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার এবং আরও নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে লড়তে নেমেছে।

এক্ষেত্রে রাহুল গান্ধির প্রশংসা অনেকখানিই প্রাপ্য। বিজেপির পাতা ফাঁদে পা না দিয়ে পালটা প্রচারের এই কৌশলটি অনেকখানিই রাহুল নির্ণয় করে দিয়েছেন এবার এবং এটাও অস্বীকার করা যাবে না, এই অভিযোগগুলির জবাবে নরেন্দ্র মোদিকে ভোট প্রচারে মুখ খুলতে বাধ্য করেছেন রাহুল।

৪ জুন ফল বেরোলেই বোঝা যাবে জাতীয় রাজনীতি কোন খাতে প্রবাহিত হবে। আরএসএসের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য সংবিধান সংশোধন করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা। সেইসঙ্গে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু, সংরক্ষণ নীতিতে বদল আনা এগুলিও আরএসএসের লক্ষ্য। এই নির্বাচনে যদি বিজেপি আবার তিনশোর বেশি আসন নিয়ে জিতে আসতে পারে, তাহলে সামনের বছর শতবর্ষে পা রেখে আরএসএস বিজেপিকে বাধ্য করবে তাদের এই সুপ্ত বাসনাকে পূর্ণ করতে। সেক্ষেত্রে হয়তো সংবিধান বদলে ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হবে। এখন ভোট বাজারে বিজেপি নেতারা যতই বলুন না কেন তাঁরা সংবিধান সংশোধন করবেন না, বাস্তবটি হল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে যদি ফিরে আসতে পারেন তাঁরা, তাহলে আরএসএসের স্বপ্নপূরণই তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হবে। তাতেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সত্যিই কি এই নির্বাচনে এতখানি শক্তি অর্জন করতে পারবে বিজেপি? নাকি তার শক্তিক্ষয় হবে? মনে রাখা দরকার গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তিনশোর বেশি আসন জিতলেও ভোট পেয়েছিল ৩৭ শতাংশ। ৬৩ শতাংশ ভোট বিজেপির বিপক্ষে ছিল। গত নির্বাচনে জোরদার কোনও বিরোধী জোট বিজেপির বিরুদ্ধে ছিল না। এবার জোরদার বিরোধী জোট রয়েছে। ফলে বিরোধী ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তদুপরি, ষষ্ঠ দফা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন ভোট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে বিজেপির এবার আসন বাড়ার সম্ভাবনা কম। বরং বেশ কিছু রাজ্যে আসন কমার সম্ভাবনাই রয়েছে। শেষপর্যন্ত কে কোন পথে দেশকে চালিত করবে তা জানার জন্য আর দিনকয়েক অপেক্ষা করতে হবে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

বিপুল পরিমাণ গাঁজা সহ গ্রেপ্তার ২ যুবক

0
নিশিগঞ্জ: পাচারের আগে বিপুল পরিমাণ গাঁজা সহ দুই যুবককে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। বুধবার বিকালে গোপন সূত্রে খবর পেয়ে নিশিগঞ্জ ফাঁড়ির ওসি সৌগত দাসের নেতৃত্বে...

Uttar Pradesh | কাজ করতে করতেই হৃদরোগে আক্রান্ত! মাত্র ৩০ বছর বয়সেই মৃত্যু ব্যাংক...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মাত্র ৩০ বছর বয়সেই হৃদরোগে আক্রান্ত (Heart attack) হয়ে প্রাণ হারালেন এক ব্যাংক কর্মী (Bank employee)। মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে...

মুঠো মুঠো চুল পড়ছে? পেঁয়াজের রস ব্যবহার করলেই মিলবে সমাধান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চুল পড়ার ঘরোয়া টোটকা হিসাবে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করার চল বহু পুরোনো। পেঁয়াজে সালফারের পরিমাণ বেশি। এই খনিজটি নতুন চুল...

Sunita Williams | ফুরিয়ে আসছে মহাকাশযানের জ্বালানি! সুনীতাদের ফেরা নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ, কী বলছে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ মহাকাশযানে ত্রুটি! আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে আটকে পড়েছেন সুনীতা উইলিয়ামস ও তাঁর সঙ্গী নভোশ্চর। ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে মহাকাশযানের জ্বালানি। মহাকাশযানে একের...

Vivaan Ghosh | শ্যুটিং সেরে ফেরার পথে বড় দুর্ঘটনা, জখম অভিনেতা ভিভান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ধারাবাহিকের শ্যুটিং সেরে ফেরার পথে বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়লেন টলিউড অভিনেতা ভিভান ঘোষ(Vivaan Ghosh)। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচলেন তিনি। জানা...

Most Popular