সৌরভ রায়, ফাঁসিদেওয়া: একেবারে জামতাড়া(Jamtara) গ্যাংয়ের ঢংয়েই চলত পুরো কাজকর্ম। গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে ভাড়ায় নেওয়া হত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। আর সেই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে চলত সাইবার প্রতারণার(Cyber Fraud) কারবার। শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসিদেওয়া ব্লকের চটহাট বাঁশগাঁও গ্রাম পঞ্চায়েতের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামে ঘাঁটি তৈরি করেছিল প্রতারকরা। মঙ্গলবার সেখানে দুটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একাধিক ব্যাংকের প্রায় চারশো পাশবুক, শতাধিক চেকবুক ও পাঁচশোরও বেশি এটিএম কার্ড উদ্ধার করল পুলিশ। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পশ্চিম নীচবাজারের বিটলাকলার বাসিন্দা অনিল গোপকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সন্দেহভাজন আরও দুজন পলাতক।
সাইবার ফাঁদে পড়ে রোজ সর্বস্বান্ত হয়ে যান কত মানুষ। গচ্চা যায় তিলে তিলে ব্যাংকে জমানো সঞ্চিত অর্থ। দীর্ঘ বছর ধরেই এই প্রতারণার পেছনে নাম উঠে আসছে বিহারের জামতাড়া গ্যাংয়ের। পুলিশের একাংশ মনে করছে, ফাঁসিদেওয়ায় যেভাবে চক্রটি কাজ করত, তার সঙ্গে জামতাড়া গ্যাংয়ের সাদৃশ্য রয়েছে। ফলে জামতাড়া গ্যাংয়ের সঙ্গে চক্রটির যোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কোনও চক্রও এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ।
দার্জিলিংয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কার্সিয়াং) অভিষেক রায় বলছেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এই চক্রটি অ্যাকাউন্টগুলির মাধ্যমে টাকা তুলত এবং সেগুলি আরেক জায়গায় চালান করত। স্থানীয় বেশ কয়েকজন জড়িত রয়েছে।’
মঙ্গলবার সকালে ফাঁসিদেওয়ার চটহাটে বিশাল পুলিশবাহিনী দেখেই সন্দেহ জেগেছিল স্থানীয়দের। বড় কোনও ‘অপরাধ’ সংগঠিত হয়েছিল সীমান্তের গ্রামটিতে, তা টের পেয়েছিলেন আমআদমিও। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত টানা ১০ ঘণ্টার অভিযান শেষে পুলিশ যখন বেরিয়ে এল, তখন স্পষ্ট হল সন্দেহটা নিছক সন্দেহই নয়। সত্যিই বটে। কোথাও টিনের চালাঘরের ভেতরে বস্তায় ভরা কয়েকশো পাসবই, চেকবই, কোথাও আবার বিছানার নীচে থরে থরে সাজানো এটিএম কার্ড। সংখ্যাটা পাঁচশোর কম নয়।
স্থানীয় সূত্রে খবরের ভিত্তিতেই এদিন চটহাটের পশ্চিম নীচবাজারের বিটলাকলা এবং মুড়িখাওয়া মোড় সংলগ্ন হাগড়াগছ এলাকায় দুটি বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। অভিযানে নেতৃত্ব দেন মিরিকের এসডিপিও বিনোদ মিনা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কার্সিয়াং) অভিষেক রায়। ছিলেন সার্কেল ইনস্পেকটর (নকশালবাড়ি) সৈকত ভদ্র, ফাঁসিদেওয়ার ওসি ইফতিকার উল হাসানও। অভিযান শুরু হয় বিটলাকলায় একটি বাড়িতে৷ সেখানে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের প্রচুর সংখ্যক পাশবই, চেকবই, এটিএম কার্ড মেলে। সেগুলি সবই অন্য ব্যক্তিদের নামে রয়েছে। বাড়িটিতে দুটি আলাদা ঘরে থাকতেন দুই ভাই অনিল গোপ এবং তপন গোপ। পুলিশের অভিযানের খবর পেয়েই গা ঢাকা দেন তপন। অনিলকে পুলিশ আটক করে।
অন্যদিকে, অভিযান শুরু হয় হাগড়াগছে মহম্মদ সইদুলের পাকা ঝাঁ চকচকে বাড়িতে। সেখান থেকেও একইভাবে ব্যাংকের পাশবই, চেকবই, এটিএম কার্ড উদ্ধার হয়। মিলেছে বিভিন্ন টেলিকম অপারেটরের প্রচুর সিমকার্ডও। সেই সঙ্গে নগদ ৪১ হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, সইদুল তৃণমূল কংগ্রেসের ফাঁসিদেওয়া ব্লকের এক শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ। চটহাট বাজারে সামান্য মোবাইলের দোকান চালান তিনি। গত কয়েক বছরে একাধিক পাকা বাড়ি তৈরি করে ফেলেছেন। তাঁরই দোকানে কাজ করেন অনিল। সইদুলের এক প্রতিবেশী বলছেন, ‘সইদুল কিছুদিন পরপরই দুবাই যেত। সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্টও করত। সোমবারই ও দুবাই থেকে ফিরেছে। এরপরই পুলিশি হানা। মোবাইলের দোকান থেকে কত আয় হয় যে, দু’দিন পরপর দুবাই যায়।’
পুলিশের অভিযান টের পেয়েই গা ঢাকা দিয়েছেন সইদুল ও তপন। এদিন সইদুলের একটি বাড়িতে শুধু অভিযান চলেছে। স্থানীয়দের ধারণা, অন্য বাড়িগুলিতে অভিযান চালালে আরও বেশকিছু নথি পেতে পারে পুলিশ।