- সন্দীপন নন্দী
প্রতিশ্রুতি কী? ভালো বাংলায় অঙ্গীকার, প্রতিজ্ঞা! আরেকটু ভেঙে অর্থ দাঁড়ায় কথা রাখা।
এবছর আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটি আশি বছর পেরিয়ে গেল। এর মাঝেই পৃথিবীর প্রান্তে, উপান্তে অফুরান কথা দেওয়ার কাজ চলছে নিরন্তর, নিরলস। প্রেমে-অপ্রেমে, ক্রোধে-আশ্বাসে, শয়নে-স্বপনে, ক্রীড়াঙ্গন থেকে অফিস করিডরে, সংবাদ থেকে সার্কাসের শিরোনামে, সর্বত্র ফিশফিশ করে, কখনও প্রবল প্রতাপে নয়তো নয়নঠারে যে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়েছে অহরহ।
কীরকম? ভোট প্রচারে একজন স্বর গরম করে বলেছিলেন, ফিরে এলে কৃষকদের জন্য সারে ভরতুকি বাড়াবেন। কোথাও ধুলোমলিন এক গোধূলিহাটের ভাষণে ভেসে আসে, কর্মক্ষেত্রে নারীর হক আর ধক প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি। কেউ বললেন ক্ষমতায় এলে, রোজ রজনীতে একজন ভারতবাসীও নিরন্ন পেটে ঘুমোতে যাবেন না। অনেকে বুকে হাত রেখে শপথ নিলেন স্বরচিত বক্তৃতায়, চেয়ার পেলে দেশের কোনও গ্রাম আঁধারে আবৃত থাকবে না আর।
তবু আশ্চর্য এই যে, অযুত আশ্বাসবাণী আওড়ানোর পরও কারও কণ্ঠ কাঁপেনি একবার। প্রতিশ্রুতিগুলো আদতে পালন করা যাবে কি না, সে সম্পর্কিত কোনওরকম হোমওয়ার্ক না করেই অধিকাংশ প্রার্থীরা ভোট ময়দান গরম করে ফিরে যান। যেন এসব কোনও ছায়াছবির সংলাপমাত্র। শুধু বলে যাও।
এটাই ভোটকালে অঘোষিত প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার সেরা মেকানিজম। আপাত সত্য কথার জালে জড়িয়ে জনরায়কে আত্মপক্ষে প্রভাবিত করবার শ্রেষ্ঠ প্রয়াসপর্বও বটে। ফলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর উত্তাল তরঙ্গক্ষেত্রে নির্ঝরের এই স্বপ্নভঙ্গ চলছে, চলবে। তাই দিকে দিকে সকল প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগটাই স্রেফ কথার কথা ভেবেই নিরুদ্দেশ হয়েছেন নেতারা।
ডিএ থেকে ডেমোক্রাসি, জিডিপি হতে ইহজীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বৃত্তান্তেই আকৃষ্ট নাগরিক। ফলে পরিচিত শব্দছকেই যুগে যুগে কথা দেওয়া চলেছে। অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার বোষ্টুমী কিংবা নাদের আলীর মতো চৌত্রিশ বছর পেরিয়ে যায় অচিরে, কেউ কথা রাখেনি।
আসলে সব প্রতিশ্রুতিগুলো ভোট পেরোলেই জনহীন সংসদ ভবনের দেওয়ালে যেন বাজে, করুণ সুরে।
তাই স্মৃতি এক বড় ঝামেলার বস্তু। কোনও ব্যক্তির উচ্চারণে যে বর্ণমালারা একবার মগজে সিঁধিয়ে গেলেই হল। সময়মতো সে ফেরত চাইবেই। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক উৎসবে আপনি কী বলে ভোট চাইলেন আর ভোটের ফল ঘোষণার পর কী আচরণ করলেন, মানুষ কিন্তু পরম আগ্রহে অপেক্ষা করে। এমন ভাবার কারণ নেই যে, প্রতিশ্রুতির আপ্তবাক্যগুলো বিস্মৃত হয়েছেন তাঁরা।
সে ধানের খেত হোক কিংবা ধ্যানের ক্ষেত্র, ভোটার জবাব চাইবেই। সাতকাণ্ড রামায়ণের ন্যায়ে সাত দফা ভোটপর্ব সমাপ্তির পর আবার এক মহান ফলাফলের প্রতীক্ষায় দেশবাসী।
পরিবর্তন নাকি প্রত্যাবর্তন? সময়ের দাবি মেনে জানিয়ে দেবে কাউন্টিং হল। কিন্তু মানুষকে বোধহীন ভাবার কারণ নেই। কেননা দীর্ঘদিন ঠেকে ঠেকে সে আজ কষ্টিপাথর। ঠিক বেঠিক যাচাইয়ের ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিটি প্রতিশ্রুতির হিসেব রাখে।
তাই ভোটাধিকারকে এবার নির্বাচন কমিশন ভোটশক্তি বলেছেন। তর্জনীর যে চাপে যাবতীয় অবহেলা অন্যায়ের জবাব দিতে পেরেছেন এক নগণ্য তরুণ থেকে ফুটপাথের হতভাগ্য তরুণী। তাই প্রতিশ্রুতি এখন আর পৌরাণিক কথার কথা নয়।
(লেখক প্রবন্ধকার। বালুরঘাটের বাসিন্দা)