রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি: কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা (Train Accident) কাণ্ডে ধোঁয়াশা এখনও কাটছে না। কেন দুর্ঘটনা ঘটল? কেন একই লাইনে দুটি ট্রেন চলে এল? কেন মালগাড়ির চালক ব্রেক কষতে পারলেন না? ব্রেক কষলেও কি তাহলে ব্রেক লাগেনি? এই ধরনের একাধিক প্রশ্ন এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের অন্তর্তদন্তে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের (Kanchanjunga Express) দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পেছনে একাধিক রেলকর্মীর গাফিলতি থাকতে পারে। ম্যানুয়াল সিগন্যাল অর্থাৎ পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট দিতে গিয়েই বিপত্তি ঘটেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
অন্যদিকে, যে সিগন্যালিং ব্যবস্থার মাঝে এই দুর্ঘটনা ঘটে তাঁর আগেই একটি লেভেল ক্রসিং ছিল। ওই ক্রসিংয়ের গার্ড যখন দেখলেন একই লাইনে দুটি ট্রেন চলে এসেছে তবে সঙ্গে সঙ্গে কেন চালকদের সতর্ক করলেন না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সোমবার ভোর থেকেই রাঙ্গাপানি (Rangapani) এবং চটহাটের মাঝে রেলের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা কাজ করছিল না। তাই সমস্ত ট্রেনকে টিএ ৯১২ ফর্ম দিয়ে অর্থাৎ মেমো দিয়ে সিগন্যাল পাস করানো হচ্ছিল। সেইমতো সকাল ৮টা ২৭ মিনিট নাগাদ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে টিএ ৯১২ ফর্ম দেওয়া হয়। ওই ফর্ম অনুযায়ী রাঙ্গাপানি থেকে চটহাট স্টেশন পর্যন্ত এ ৬৩৮, এ ৬৪০, এ ৬৪২, এ ৬৪৪, এ ৬৪৬, এ ৬৪৮, এ ৬৫০, এ ৬৫২, এ ৬৫৪ এই নয়টি সিগন্যাল পার করতে পারবেন চালক। যদি সিগন্যাল সবুজ থাকে তবে দিনের বেলা ১৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা এবং রাতে ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে ট্রেন পার করতে পারবে। তার আগে প্রতিটি স্টেশন কিংবা লেভেল ক্রসিংয়ে দিনের বেলা হলে এক মিনিট এবং রাতে হলে দুই মিনিট করে দাঁড়াতে হবে। সেটি মেনেই চলছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। ঠিক তার ১৫ মিনিট বাদে রাঙ্গাপানি স্টেশন থেকেই মালগাড়িকে টিএ ৯১২ ফর্ম দিয়ে সিগন্যাল পার করার অনুমতি দেওয়া হয়। একই লাইনে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা রয়েছে সম্ভবত সেটা জানানোই হয়নি। বরং টিএ ৯১২ ফর্ম দিলেও সেখানে টিডি ৯১২ ফর্মের মতো নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
কী এই টিডি ফর্ম? ভারতীয় রেলের রুল বুকে এই ফর্মের মানে সামনের লাইনে কোনও ট্রেন নেই। চালক প্রতিটি স্টেশন কিংবা লেভেল ক্রসিং ২৫ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন ছুটিয়ে নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। এখানেই তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। এ ৬৫২ থেকে এ ৬৫৪ সিগন্যালিং ব্যবস্থার মাঝে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চালক রুল বুক মেনেই ট্রেন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে কি মালগাড়ির চালকের বুঝতে ভুল হয়েছিল? নাকি অন্য কারও ভুলের জন্য মালগাড়ির চালক টিডি ৯১২ ফর্মের নিয়ম অনুযায়ী ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে সমস্ত সিগন্যাল পার করছিলেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে টিডি ৯১২ ফর্মের নির্দেশিকা ধরে নিয়েই মালগাড়ি ছুটছিল। তাই মালগাড়ির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। জরুরিকালীন ব্রেক কষলেও মালগাড়িকে নির্ধারিত স্পিড থেকে শূন্যে নামতে অন্তত ১৭ থেকে ২০ সেকেন্ড সময় কিংবা ৫০০ থেকে ৭০০ মিটার দূরত্ব প্রয়োজন হয়। রেল জানিয়েছে, মালগাড়ি ওই সময় ঘণ্টায় ৭৮ কিলোমিটার বেগে ছিল। রাঙ্গাপানি স্টেশন থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থল পর্যন্ত মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যে ৭৮ কিলোমিটার গতিবেগ হওয়া অসম্ভব বলেই জানাচ্ছেন রেলের বিশেষজ্ঞরা। তাই তাঁদের মতে দুর্ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন গতি অন্তত ৫০ থেকে ৬০ ছিল এবং চালক ৩০০ থেকে ৪০০ মিটার দূরত্বে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন। মালগাড়ির ভর বেশি থাকায় ব্রেক ধরতে একটু সময় লাগেই। তাই আর শেষরক্ষা হয়নি।