Tuesday, July 2, 2024
Homeকলামধমক খেয়ে নড়াচড়ার মেয়াদ আর কতদিন

ধমক খেয়ে নড়াচড়ার মেয়াদ আর কতদিন

  • শুভ সরকার

উত্তর থেকে দক্ষিণ, বঙ্গের বিভিন্ন শহরে মঙ্গলবার প্রশাসনের কর্তাদের ‘কর্মব্যস্ততা’ দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। পড়াশোনায় ভালো ছেলে ছিলাম না কোনওকালে। স্কুলের স্যররাও আমার উপর খুব একটা খুশি ছিলেন না। বলতে গেলে পাড়ার স্কুল। বাবার সঙ্গে একাধিক স্যরের চেনাজানা ছিল। আমার কীর্তিকাহিনী তাই বাবার কানে পৌঁছে যেত সময়ে সময়ে। বাবা যে সবসময় অ্যাকশন নিতেন, তা নয়। সেসব কালেভদ্রে ঘটত। তবে যখন ঘটত, আশপাশের বাড়ির লোকজন টের পেতেন। তারপর আমি ‘শুধরে’ যেতাম। অন্তত সপ্তাহখানেকের জন্য তো বটেই।

কী আশ্চর্য! সেই একই মডেল এখন এ রাজ্যে!

সোমবার মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে নবান্নে ডেকে একপ্রস্থ কড়কে দিলেন। তারপর মঙ্গলবার হঠাৎ আলিপুরদুয়ার থেকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকে ময়নাগুড়ি, সব জায়গায় প্রশাসন খুব তৎপর হয়ে উঠল। এখানে আবর্জনা সাফাই, ওখানে জবরদখল উচ্ছেদ, এক্কেবারে যাকে বলে ‘কুইক অ্যাকশন।’ একটা শহরে ফুটপাথে লোকে হাঁটতে পারেন না। ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে অস্থায়ী শপিং মল বানিয়ে রেখেছেন। আরেকটা শহরে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতে নাকে রুমাল চাপা দিতে হয়। অন্য একটা শহরে পুলিশলাইনের নাকের ডগায় খাসজমি দখল হয়ে যায়।

প্রশাসন কি এতদিন ঠুলি পরে বসেছিল আর মুখ্যমন্ত্রীর এক ধমকে সেই ঠুলি খসে পড়ল? এঁরা সকলে ভারিক্কি অফিসার। আশা করি, প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাহলে কাজ করার জন্য নবান্ন থেকে নাটকীয় ধমকের দরকার পড়ে কেন? নাকি কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি অবধি হোমরাচোমরা কর্তাদের বয়সটাই কেবল বেড়েছে, ভেতরে ভেতরে সকলেই সেই ফাঁকিবাজ কোনও খুদে! তাই যদি হয়, তাহলে তো বলতে হয়, এঁদের কারও উচ্চপদে বসার না আছে যোগ্যতা, না আছে ম্যাচিওরিটি আর না আছে অধিকার!

কোচবিহার শহরের সঙ্গে পরিচিত সবাই জানেন, রাসমেলা মাঠটা একেবারে শহরের মধ্যিখানে, সকলের চোখের সামনে। সেই রাসমেলা মাঠ চত্বর যে জবরদখল হয়ে গিয়েছে, এতদিন বুঝি কারও চোখে পড়েনি? আচ্ছা, আপনাদের কারা কারা আলিপুরদুয়ার শহরে গিয়েছেন? যাঁরা গিয়েছেন বা থাকেন, তাঁরা জানেন, আলিপুরদুয়ার চৌপথিকে সেই শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। সেখানে ফুটপাথ যে ব্যবসায়ীদের কবজায় চলে গিয়েছে, সেকথা তো নতুন নয়। বলতে বলতে হাল ছেড়ে দিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা। হয়তো ধরেই নিয়েছেন, ফুটপাথে পা রাখার সুযোগ না পাওয়াটাই ভবিতব্য।

মঙ্গলবার যে মহকুমা শাসক সেখানে অভিযান চালালেন, এতদিন বুঝি তিনি সেই ভোগান্তির দৃৃশ্য দেখেননি? বাসিন্দাদের দুর্ভোগ টের পাননি? আলিপুরদুয়ারে কোথায় বসেন তিনি যে, এ সব তাঁর নজর এড়িয়ে যায়? ময়নাগুড়ি শহরের কথা ধরা যাক। সেখানকার বাজারের জবরদখল সরাতে একদিন সময় দিয়েছেন পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান মনোজ রায়। এখন তো তিনি কড়াকড়ি করবেনই। কারণ, একদিন আগে চেয়ারম্যানদের ডেকে কথা শুনিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এখন কাজ না দেখিয়ে এই জনপ্রতিনিধি, অফিসাররা যাবেন কোথায়!

আসলে কাজ করার অভ্যাস একটা বড় ব্যাপার। কাজ না করতে করতে এঁদের অনেকের স্বভাব খারাপ হয়ে গিয়েছে। আমি একজন আধিকারিকের কথা জানি, যিনি হঠাৎ হঠাৎ খেয়ালখুশি মতো অভিযানে বের হন। তাঁর সেই অভিযানে কাজ হয় কি না, সেটা বড় কথা নয়। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হল তিনি সংবাদমাধ্যমে কতটা ফুটেজ পান। অভিযানে বের হলে ডেকে নেন পছন্দের সাংবাদিকদের। কখনো-কখনো নিজেই নিজের কৃতিত্বের ছবি পাঠিয়ে দেন কাগজে ছাপানোর জন্য।

সাংবাদিকরা দু’কলম লিখে দেন, অমুক জায়গায় গিয়ে খাবারের মান দেখে অখুশি সেই আধিকারিক বিরিয়ানির হাঁড়ি উলটে দিয়েছেন। কাগজে তা ছাপা হয়। কিন্তু সেই আধিকারিক ফিরে গেলে উলটে যাওয়া হাঁড়ি সিধে করে আবার বিরিয়ানি বিক্রি শুরু হয়। ওই দোকানদার ও অন্য ব্যবসায়ীদের কিছু যায় আসে না এ সবে। তাছাড়া অভিযানে আদৌ কোনও স্থায়ী ফল হল কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামান না সেই আধিকারিকও।

যাঁরা ভাবছেন, মুখ্যমন্ত্রীর হুংকারের পরে বুঝি সব ঠিক হয়ে গেল, সব কাজ এবার ঠিকঠাক হবে কড়া নজরদারিতে, তাঁদের মতো সরল লোক আর হয় না। মাঝে মাঝে এসব বলতে হয়। একটু হইচই করতে হয়। রাজ্যের এমুড়ো-ওমুড়ো বিভিন্ন শহরে যে অসন্তোষ বাড়ছে, সেটা সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট। তৃণমূলের সার্বিক ফল যতই ভালো হোক, রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে একের পর এক পুর এলাকায় বিজেপির এগিয়ে থাকাটা। তা‌ই অসন্তোষের ক্ষত ঢাকতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। নাহলে ধারাবাহিক রক্তক্ষরণ যে অবশ্যম্ভাবী।

তাহলে মানেটা কী দাঁড়াল? তিনি ধমকে দিলেন ক্ষোভ কমাতে। তাঁরা ব্যবস্থা নিলেন লোক দেখাতে। আর আমরা? খানিক হাততালি দিই। একটু হলেও, কয়েকদিনের জন্য হলেও, কিছু কাজ তো হল। প্রশাসন যে কাজ-টাজ করে, সেটাই তো ভুলতে বসেছিলাম। তাই না?

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

The Sherpa Trail | দার্জিলিংয়ের অবলুপ্ত ‘টাইগার’ অধ্যায়ের কাহিনী

0
অনিমেষ দত্ত, শিলিগুড়ি: টাইগার শব্দটা বললেই প্রথমে বাঘের কথা মাথায় আসে। তবে প্রচণ্ড শারীরিক দক্ষতা কিংবা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, এমন কিছু অর্জন করা বোঝাতেও...

পাহাড়পথে ডিজিটাল কিয়স্ক থেকে সেলফি জোন, জবরদখল সরিয়ে ‘স্মার্ট’ হতে উদ্যোগী ডিএইচআর

0
শিলিগুড়ি: ঐতিহ্য ধরে রেখে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েকে (ডিএইচআর) আধুনিকতার মোড়ক দিতে চাইছে রেল। তাই পাহাড়পথে ডিজিটাল কিয়স্ক থেকে সেলফি জোন তৈরি, রেললাইনের ধারের জবরদখল...

CV Anand Bose | শ্লীলতাহানি কাণ্ডের জের! মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলেন রাজ্যপাল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চোপড়াকাণ্ড নিয়ে উত্তাল রাজ্য। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ...

Falakata | খুদেদের বিনামূল্যে চারা বিলি করেন গাছকাকু, পড়ুয়াদের সবুজের গুরুত্ব বোঝাতে উদ্যোগ ঈশ্বরের...

0
ফালাকাটা: ছোটরা ফুলের ভাষা বোঝে। ওদের কাছে পৃথিবীকে সবুজ করার দায়িত্ব অনায়াসে দেওয়া যেতে পারে। এই কথায় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন ঈশ্বর রায়। সবুজের গুরুত্ব...

Hina Khan | অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান থেকেই হাসপাতালে! প্রথম কেমোথেরাপির ভিডিও পোস্ট করে আবেগপ্রবণ হিনা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: স্টেজ থ্রি স্তন ক্যানসারে (Breast cancer) আক্রান্ত অভিনেত্রী হিনা খান (Hina Khan)। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেকথা জানিয়েছেন নিজেই। কিছুদিন আগে পর্যন্তও...

Most Popular