অনিমেষ দত্ত, শিলিগুড়ি: টাইগার শব্দটা বললেই প্রথমে বাঘের কথা মাথায় আসে। তবে প্রচণ্ড শারীরিক দক্ষতা কিংবা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে, এমন কিছু অর্জন করা বোঝাতেও ‘টাইগার’ শব্দটি ব্যবহার হয়। এই যেমন শেরপাদের ক্ষেত্রে। ১৯৩৯ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান ক্লাব শেরপা পোর্টারদের ‘টাইগার ব্যাজ’ দেওয়া শুরু করে। এই ব্যাজ তঁারাই পেতেন যঁারা হাই অলটিটিউডে দুর্দান্ত পারফর্ম করতেন। টাইগার ব্যাজ পাওয়া প্রথম দলে ছিলেন তেনজিং নোরগে। তখনও কি কেউ জানত, দেড় দশক পর তিনি ইতিহাস গড়বেন? সোমবারের বৃষ্টিভেজা বিকেলে এমনই সব গল্প শোনাচ্ছিলেন দীপা বলসওয়ার ও নন্দিনী পুরন্দর। সম্প্রতি ‘দ্য শেরপা ট্রেইল’ নামে একটি বই লিখেছেন তঁারা।
শেরপাদের নিয়ে নানা মিথ এমনকি স্টিরিওটাইপ লিপিবদ্ধ হয়েছে নানা সময়। তাদের তিনটে ফুসফুস, কায়িক শ্রমে সবার উপরে, খুব সাধারণ ইত্যাদি। একসময় ব্রিটিশরা পর্বতারোহণের আগে বলত, ‘কিছু খাবার নিয়েছি, সঙ্গে গরম পোশাক আর কিছু শেরপা।’ শেরপারা ছিলেন বস্তুস্বরূপ। তঁাদের নাম পর্যন্ত মুখে আনত না কেউ। লেখকদের মতে, পর্বতারোহণের ইতিহাসে ফুটনোট হয়ে থেকে গিয়েছেন শেরপারা।
এদিন শালবাড়ির একটি ক্যাফেতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শেরপাদের জীবনের নানা অলিগলি ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন দীপা-নন্দিনী। প্রথমেই দীপা বললেন, ‘শেরপাদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। তাই তঁারা নিজেদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। েমৗখিক ইতিহাসের উপর ভর করেই আমরা কাজ শুরু করি।’
কথা বলতে বলতে নন্দিনীর হঠাৎ মনে পড়ে গেল সোনার কথা। খানিকটা হেসে বললেন, ‘সোনার ডাকনাম কিংকং। নেপাল থেকে পেটের তাগিদে দার্জিলিংয়ে এসে পোর্টারের কাজ শুরু করেন। ততদিনে তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে ফেলেছেন। তেনজিংয়ের দার্জিলিংয়ের বাড়িতে অনেক কুকুর ছিল। সোনাকে সেই পোষ্যদের দেখভালের কাজ দিলেন তেনজিং।’
তঁার কথা শেষ না হতেই দীপা আলতো হেসে বলে উঠলেন, ‘সোনার ডাকনামটা কিন্তু তেনজিংয়ের দেওয়া। এই সোনা কিংকং দার্জিলিংয়ের শেষ টাইগার। এখন আর টাইগার ব্যাজ দেওয়া হয় না।’ শেরপারা কীভাবে এত সহজে পাহাড়ে চড়েন? নন্দিনীর সটান উত্তর, ‘দে ফলোড দ্য সান (তঁারা সূর্যকে অনুসরণ করেন)।’
আং থারকে, নাওয়াং গমবু, পাসাং লামাদের মতো বিখ্যাত শেরপা পর্বতারোহীদের গল্প, মিথ, অর্জনের কাহিনী এখন অতীত। বর্তমানে বাবা-মায়েরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাহাড় চড়তে দিতে উৎসাহী নন, পর্যবেক্ষণ করেছেন দীপা। দার্জিলিংয়ে শেরপা বসতি নামে পরিচিত তুংসুং, আলুবাড়ি কিংবা ঘুমে এখন তরুণ শেরপারা অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
বর্তমানে পর্বতারোহণে অনেক বদল এসেছে। এসেছে নয়া প্রযুক্তি। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বদলে যাচ্ছে পাহাড়ের চরিত্র। তাই হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না তঁারা। অন্তত দার্জিলিংয়ে এমনই ছবি ধরা পড়েছে নন্দিনীর চোখে।