কালিম্পং: কালিংপং জেলার প্রত্যন্ত এলাকা শ্যামাবিয়ং চা বাগানের সর্পিলাকার পথ শেষ হয়েছে গীতখোলা নদীর ধারে। বর্ষার গীতখোলা সুরমূর্ছনা তোলে। মেঘ-কুয়াশার খেলা চলে। গীতখোলার পাশ দিয়ে শুনশান পিচে মোরা রাস্তা চলে গিয়েছে পাহাড়ের আরেক বিস্ময় নোকদাড়া ঝিলের দিকে। মোড়ের ঠিক কোণে একটি কাঠের ঘর। সামনে রাখা হুইলচেয়ার। তাতে বসে রয়েছেন এক মাঝবয়সি ব্যক্তি। পাশে তাঁর স্ত্রী। দুজনেই কবিতা নিয়ে আলোচনায় মশগুল। এই ব্যক্তির হার না মানা অদম্য মানসিকতা আর ভালোবাসার কাহিনী যেকোনও সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে।
অর্জুন শর্মা নিরোলা, বিশেষভাবে সক্ষম। তারপরও তাঁকে বিয়ে করে ভালোবাসার বন্ধনে আগলে রেখেছেন স্ত্রী সরোজা বানতোয়া রাই। কবি দম্পত্তির অমোঘ ভালোবাসার কাহিনী, প্রত্যন্ত গীতখোলায় কার্যত বিস্ময়। অর্জুন বাবুর জীবন কাহিনী রীতিমতো শিহরণ জাগানো। শৈশব থেকেই কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন তিনি। গ্রামের স্কুলে পড়ার পর রঙ্গু উচ্চ বিদ্যালয়, কালিম্পং এর একটি স্কুল এবং দার্জিলিং কলেজে তাঁর পঠন-পাঠন শেষ হয়। পিওর সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে লাভা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজও শুরু করেন। পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের জন্য সে সময় দাপিয়ে রাজনীতি করতেন। হয়তো অদৃষ্টের পরিহাস তার জানা ছিল না।
২০০৩ সালে ২২ জুলাই লাভার কাছে একটি বাস দুর্ঘটনা হয়। তাতে অর্জুনও ছিলেন। তাঁর মেরুদণ্ড ক্ষতি হয়। কোমর থেকে নীচের অঙ্গ অসাড় হয়ে যায়। চিকিৎসার পর কোনক্রমে জীবন ফিরে পান। দুর্ঘটনার পর চিরজীবনের জন্য সঙ্গী হয়ে যায় হুইলচেয়ার। হুইলচেয়ার বন্দি পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকার থেকেই এখন দুনিয়া দেখেন। প্রযুক্তির পরিবর্তন দেখেছেন। অর্জুন বাবুর লড়াই করার অদম্য মানসিকতা থেকেই বাড়িতে একসময় ছোট্ট দোকানও চালাতেন। নিরন্তর লেখালেখি কিন্তু কখনওই থামেননি। এমনকি প্রযুক্তির সঙ্গে এগিয়ে সামাজিক মাধ্যম কেউ হাতিয়ার করেন। ২০১৮ সালে তার ভাব তরঙ্গ কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এক সময় একে একে মা-বাবা গত হন। অনেকটাই নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। সে সময় ২০২০ সালে করোনা পর্বেই তার জীবনে আসেন সারোজা। সামাজিক মাধ্যমে আলাপচারিতা, ভালোবাসা। সরোজা পাহাড়ের একটি স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনিই আপন করে নেন অর্জুনকে। দুজনেই দুজনকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেন।
ইতিমধ্যে সারোজার কবিতার বই ‘প্রস্ফুটন’ও প্রকাশিত হয়েছে। এখানেই থেমে থাকতে চান না এই দম্পতি। তারা সাহিত্যপ্রেমী সহ বিভিন্ন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। অনেকে এসে তার খোঁজ খবরও নিয়ে যান। সম্প্রতি দিল্লির রবীন্দ্র ভবনে বিশেষভাবে সক্ষমদের জাতীয় স্তরের সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে। সেখানে নেপালি সাহিত্যের থেকে যোগ দিয়েছিলেন অর্জুনও। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই তাঁর দিল্লি যাত্রা। সম্মেলনে অংশ নিয়ে সদ্য গ্রামে ফিরে এসেছেন তাঁরা।
অর্জুন, সরোজা বলেন, ‘জীবনে প্রতিবন্ধকতা আসবেই। আমরা চাই ভালবাসার মাধ্যমে সেই প্রতিবন্ধকতা গুলোকে অতিক্রম করতে। জীবন থেকেই জীবনের রসদ খুঁজি।’ এই দম্পতির অদম্য মানসিকতাকে কুর্নিশ জানায় বিভিন্ন মহল। নেপালি সাহিত্য অঙ্গনের সভাপতি তথা ডুয়ার্স নেপালি সাহিত্য বিকাশ সমিতির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্ররাজ প্রধান বলেন, ‘অর্জুন বাবু এবং উনার স্ত্রী সরোজা দেবীর মানসিকতাকে কুর্নিশ জানাই।‘