প্রণব সূত্রধর, আলিপুরদুয়ার: আলিপুরদুয়ার আদালত চত্বরের রাস্তার দু’পাশে পরপর চা, পান, ভেলপুরির মতো মুখরোচক খাবারের দোকানের সারি। ডুয়ার্সকন্যা থেকে প্যারেড গ্রাউন্ড (Parade Ground) সংলগ্ন রাস্তা ধরে থানার দিকে যেতে গেলে চোখে পড়বে রাস্তার পাশে থাকা চা-বিস্কুটের দোকান। এমন দোকান তো আরও আছে। এই দোকানের দিকে বিশেষ নজর কেন? একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, দোকান সামলাচ্ছেন এক প্রৌঢ়া। আর দোকানে খদ্দেরদের ফরমায়েশ সামলাতে সামলাতেই বারবার চলে যাচ্ছেন পাশের বেঞ্চে (Bench) বসা এক খুদের দিকে।
সেই শিশু খাতা-পেন্সিল নিয়ে পড়াশোনায় মগ্ন। মাঝে মাঝেই ডাকছে, ‘দিদা, ও দিদা।’ আর ওমনি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির বছর পঞ্চাশের শুভ্রা বোস পাল। তিনিই একাধারে ওই চায়ের দোকান চালান, আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ছোট্ট নাতনিকে পড়াশোনাও শেখান।
আলিপুরদুয়ার আদালত চত্বরে একটি কদম গাছের নীচে রয়েছে সেই ছোট্ট চায়ের দোকান। একটি টেবিলে বিস্কুট সহ অন্যান্য সামগ্রী সাজানো রয়েছে। সেই দোকানের পিছনের দিকে বেঞ্চ রয়েছে। অনেকে সেখানে বসেও চা, রুটি খান। আর সেই বেঞ্চেরই একপাশে বসে খাতাকলম হাতে ইংরেজি (English) বানান লিখতে দেখা গেল আয়েশা দত্তকে। সম্পর্কে শুভ্রার নাতনি আয়েশা প্রথম শ্রেণির ছাত্রী।
তাঁদের বাড়ি জিৎপুর এলাকায়। শুভ্রার দুই ছেলে এক মেয়ে। সকলেরই ঘরসংসার রয়েছে। তবে বিধবা মেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে মায়ের কাছে থাকেন। আর দুই নাতি-নাতনির পড়ানোর দায়িত্ব দিদিমার কাঁধে। আয়েশার মাও মাঝেমধ্যে দোকান সামলান। ঘর সামলান। শুভ্রা নিজে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। আগে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন। আর এখন নাতি-নাতনিদের। আত্মবিশ্বাসী শুভ্রার কথায়, ‘দোকান ছাড়াও বাড়িতেও পড়াতে বসি। এছাড়া গল্প করতে করতে বিভিন্ন জিনিস শেখানোর চেষ্টা করি ওদের।’
দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ছোট্ট আয়েশা অনেকসময়ই বানান লিখতে গিয়ে অক্ষর চিনতে পারছে না। কখনও আবার ভুলে যাচ্ছে। তখনই ডাক পড়ছে দিদার। কোর্ট চত্বরের হইচই, রাস্তায় বাইক, অটো, টোটোর চলাচলের আওয়াজ, লোকজনের গল্পগুজব, ধুলোবালি, এসবকিছুর মধ্যেই চলছে তার পঠনপাঠন। না নাতনি, না দিদা, কেউই এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়।
খালি হঠাৎ করে দোকানে ক্রেতা এসে পড়লে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন শুভ্রা। তখন একা একাই পড়ছে আয়েশা। ফাঁকা হলে আবার গিয়ে বসছেন নাতনির পাশে। আর দোকান সামলাতে গিয়ে দিদা ব্যস্ত হয়ে পড়লে, সেই সুযোগে আয়েশা একটু-আধটু অন্যমনস্কও হয়ে পড়ছে। তখনই আবার তাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন শুভ্রা।
এভাবে পড়তে অসুবিধা হয় না? প্রশ্ন শুনে অবাকই হয় আয়েশা। সমস্যার কথা কখনও ভাবেইনি। বরং জানাল, পড়াশোনা ভালো হলে দিদা মাঝে মাঝে হাতে ধরিয়ে দেয় বিস্কুট। তাতেই মহাখুশি সে।