শুকনো মুখ, নুইয়ে পড়া কাঁধ। চোখ দুটো পুকুরের জলে স্থির। যেন কিছু খুঁজছেন। পিঠে ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি এযাবৎ নিজের রক্ত খুইয়ে জোগাড় করা সমস্ত শংসাপত্র। খুঁজছেন কারণ, কারণ হঠাৎ চাকরি চলে গিয়েছে। খুঁজছেন বেঁচে থাকার রাস্তা। খুঁজছেন লড়াইয়ের রসদ।
একটু দূরে আরেকজন চোয়াল শক্ত করে বলে যাচ্ছেন, লড়াই আমরা করব। ডান বাম তৃণ কাউকে লাগবে না। তারা সবাই জড়ো হয়েছেন আগামীদিনের রাস্তা তৈরি করতে, রাস্তা খুঁজতে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে হাতটা চেপে ধরল পরিচিত এক বোন। অত্যন্ত মেধাবী বোনটির প্রশ্ন, দিদি আমাদের চাকরি কি ফিরে পাব না? আমাদের কী দোষ বলো? জানো গ্রামে সবাই বলছে আমরা চোর তাই চাকরি গেছে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। মোছার ইচ্ছে নেই। শুকিয়ে যাচ্ছে গালে। আমার কাছেও উত্তর নেই।
হাইকোর্টের অর্ডার পড়ে যতটুকু জানা যায় যে, এই ২৬০০০ জনের মধ্যে প্রায় ৫-৬ হাজার জন ‘মাটি’ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। রাজ্যের এক নেতার কথা অনুযায়ী, ‘হাইকোর্ট আটা আর ভুসি আলাদা করতে না পেরে, পুরো প্যানেল বাতিল করেছে।’
শিক্ষকরা এখন আটা, ভুসি, মাটি, চোর এসবের সঙ্গে তুলনীয়! রাজ্যে ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এ রাজ্যের তরুণ-তরুণীরা যেসব নতুন শব্দের সঙ্গে অতিপরিচত হয়েছেন, তার মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত নিঃসন্দেহে কোর্ট, কেস, উকিল, বিচারপতি, জাজমেন্ট। কালেভদ্রে একটা চাকরির পরীক্ষা হয়, তারপর কেসের পর কেস চলতে থাকে, পাঁচ-ছয় বছর পরে কেসের জাজমেন্ট লেখা নিয়োগপত্র নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন ছেলেমেয়েরা। তারপরেও মামলা চলতে থাকে…ভাগ্য ঝুলে থাকে চূড়ান্ত রায়দানের উপর।
২০১১ সালের পর স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয় মাত্র দু’বার। ২০১১-র আগে মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো নিয়ম করে চলা একটি পদ্ধতি চূড়ান্ত অনিয়মিত হয়ে পড়ে রাজ্যে পালাবদলের পর। রিজিওনাল লেভেল টেস্ট থেকে সেটা হয়ে যায় স্টেট লেভেল টেস্ট। ২০১১-র আগে রাজ্যের সমস্ত জেলাকে অঞ্চলে ভাগ করে টেস্ট নেওয়া হত। রাজ্যে পালাবদলের পর সমস্ত নিয়ম বদলে ফেলা হয়। এমসিকিউ প্রশ্নের আদলে তৈরি করা হয় প্রশ্নপত্র। পরীক্ষা ব্যবস্থাও হয়ে যায় চূড়ান্ত অনিয়মিত।
২০১১ ও তার আগে থেকে ২০১৬ পর্যন্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করা ছেলেমেয়েরা তবুও দু’বার এসএসসি-তে বসার সুযোগ পান। ২০১৬-র পর এ পর্যন্ত পাশ করা ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে সেই সুযোগ একবারও হয়নি। শিল্পবিহীন রাজ্যে নেই অন্য কোনও বিশেষ চাকরির সুযোগ। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি তেমন। উত্তরবঙ্গ সহ বাকি জেলার ছেলেমেয়েদের কাছে নেই কোনও সেক্টর ফাইভ। তাই উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েদের কাছে বিশেষভাবে স্বপ্নের চাকরি আজও শিক্ষকতা।
২০১১ সালের পর থেকে সেই স্বপ্ন অনেকখানি ম্লান। ২০১১-তে যে তরুণের বয়স ছিল ২০, তিনি এখন চল্লিশের দিকে হাত বাড়ানো লোক। মধ্যে দুটো মাত্র এসএসসি-তে সুযোগ না পেয়ে বেছে নিয়েছেন কিছু একটা পথ। হয় লোন নিয়ে টোটো কিনেছেন কিংবা কোচিং সেন্টার নতুবা ঘাড়ে বিশাল সুখাদ্যের বোঝা নিয়ে ডেলিভারি বয়। মেয়েরা বাধ্য হয়ে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ‘ভাতাজীবী’ কিংবা শপিং মলের নামমাত্র মাইনের কর্মী।
রাজ্যে যখন চূড়ান্ত বেকারত্ব বাড়ছে, তখন এই মুহূর্তে হাইকোর্টের এই রায় চাকরিপ্রার্থী ও চাকরিরত সবার জন্যই খুব হতাশাজনক। একদল এর মধ্যেই তুমুল উল্লাসে মেতে। এক হাভাতে, ভাতাজীবী সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়া বাঙালি জাতির কাছে চাকরি হারানো প্রার্থীরা এখন ‘চোর’! সে যতই জানুক তার পাশের বাড়ির মেয়েটি কিংবা ছেলেটির লড়াই। আমার নেই, তাই তোরও নেই, আয় দুজনে মিলে চপ বেচি এই আনন্দে উল্লসিত! বেকার, চাকরি হারিয়ে সদ্য বেকার, বা চাকরি হারানোর মুখে যাঁরা দাঁড়িয়ে, তাঁদের রোষ যখন আছড়ে পড়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তা না হয়ে খিল্লি আর মিম বানিয়ে স্যাডিজম-এর মৈথুনে বাঙালি মত্ত।
তাই রাস্তায় বেরোলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, যাঁর গা ঘেঁষে বেরোলেও কোনওদিন কথা বলতেন না, তিনিও দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘দিদিমণি কী খবর, কতজন টাইট হল!’ মসজিদ থেকে রাস্তার ঠেক বাদ নেই কোথাও। নমাজ পড়তে গিয়েও বৃদ্ধ, দৃষ্টিশক্তিহীন অশীতিপর বাবাকে শুনতে হচ্ছে, সব চোরের এবার চাকরি গেল। যে বাবা জানেন তাঁর সন্তানকে কতখানি পথ পেরোতে হয়েছে স্বপ্নের শিক্ষকতা এই চাকরিটির জন্য। তিনি জানেন ভরা কুমলাই নদীতে তাঁর মেয়ে একা সাইকেল নৌকায় তুলে যখন নদী পার হত, তাঁর মেয়ের পুরো স্কুলড্রেস বৃষ্টিতে ভিজে জামা চুইয়ে জল ঝরত। তিনি জানেন, মেয়েকে বিএড পড়াতে গিয়ে কতখানি জমি তাঁকে বন্ধক দিতে হয়েছে। তাই যখন সেই বাবা শোনেন যে, তাঁর সন্তান যেহেতু ২০১৬ সালের প্যানেলে চাকরি পেয়েছে, তাই তাঁর সন্তান ‘চোর’ আর ‘মাটি’ দিয়ে চাকরি পেয়েছে। সেই বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে আর চোখের কোণ চিকচিক করে জলে। সবার অলক্ষে।
যোগ্য কে আর অযোগ্য কে- এই বিচারে না গিয়ে, একটু তলিয়ে ভাবলে উপলব্ধি করা যায়, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আজ সমস্ত শিক্ষক সমাজ আর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা। যাঁরা টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে দোষী কিন্তু জনগণের রুটি, কাপড়া আর মকান জোগানোর দায় কি রাষ্ট্রের নয়? যে রাষ্ট্রের কাছে বেকার তরুণ, তরুণীরা দাবার বোড়ে, সেই রাষ্ট্র কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যে একটি পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে গেল!
কই আমাদের রোষ সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে? চাকরি হারানোদের চিহ্নিত করে তাঁদের সামাজিক সম্মানহানি করেই কি চুপ থাকব আমরা?
কোথায় কলকাতা কাঁপানো বুদ্ধিজীবীরা? কোনও রা কাড়ছেন না কেন? ভাতঘুমে? ভাতাঘুমে? পদঘুমে? নাকি অ্যাপার্টমেন্টের দেওয়াল বড্ড মোটা, জেলাগুলোর খবর সেখানে পৌঁছায় না?
যাঁরা শিকার, তাঁদের চোর বলে নিজেদের সাধু ভেবে তৃপ্ত হলেই সব পাপ ধুয়েমুছে যায় না। চিরদিন পরিবর্তনে, লড়াইয়ে বিশ্বাস রাখা বাঙালির রোষ কোথায়? সে কি ভুলে গেছে রাষ্ট্রের দায়? আমরা কি করে চুপ থাকতে পারি বাড়ির পাশের লড়াকু মেয়েটি কিংবা ছেলেটির এই দুর্দিনে, যে কিংবা যারা অনেক কষ্টে চাকরিটা জুটিয়েছিল কিন্তু হঠাৎ সে এখন বেকার। আমাদের নীরবতা ডেকে আনছে আরও ভয়ানক দিনকে। শিক্ষা যারা কিনতে অপারগ, শিক্ষকহীন স্কুল তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে, শিক্ষার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেবে অচিরেই।
চুপ থেকে সমস্ত দায় ঝাড়তে পারি না আমরা। চুপ থাকা অপরাধে শামিল হওয়ার মতোই অপরাধ। যেমন কবি ভারাভারা রাও তাঁর ‘বুদ্ধিজীবী’ কবিতায় বলেছেন,
যখন
দুর্বৃত্তরা ক্ষমতা দখল করে
ও মানুষ তার শিকার হয়
এবং জনসাধারণকেই তারা ক্রিমিনাল বানায়-
তখন যাঁরা চুপ থাকেন
(প্রতিবাদ না করে)
তারা আসলে দুর্বৃত্তদেরই দলে।
(লেখক শিক্ষক, ময়নাগুড়ির বাকালির বাসিন্দা)
শিলিগুড়ি: ধেয়ে আসছে কালবৈশাখী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মূলত গৌরবঙ্গের তিন জেলা মালদা, উত্তর এবং দক্ষিণ…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যুদ্ধের আবহেই ইজরায়েলে পরমাণু হামলার (Nuclear attack) হুঁশিয়ারি দিল ইরান। ইজরায়েলে…
কোচবিহার: কোচবিহার(Cooch Behar) পুরসভার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ এনে ১৭ মে শুক্রবার কোচবিহার শহরে ২৪ ঘণ্টার…
শিলিগুড়ি: উত্তরবঙ্গের অত্যন্ত গর্বের ভোরের আলোয় এখন আঁধারের মেঘ। সিকিমে হ্রদ বিপর্যয়ের জেরে তিস্তায় পলির…
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (PM Narendra Modi) সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কে (Debate) বসতে…
This website uses cookies.