উত্তর সম্পাদকীয়

ছাত্রছাত্রীরা যেন বিস্মৃত চারাগাছ

  • রম্যাণী গোস্বামী

দক্ষিণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উত্তর, দমদম থেকে ফুলবাড়ি এই এপ্রিল শেষেই জ্বলছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে। পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন আলোচনায় বারবার উঠে আসছে গাছ লাগানোর কথা। যা কিনা নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং উন্নয়নের নামে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতিসাধন অর্থাৎ এযাবৎ ঘটে চলা আমাদের লোভ ও ভুলের একমাত্র মাশুল। নতুন করে রোপিত এক লক্ষ কোটি গাছের মন্ত্রশক্তি এই খরতপ্ত পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে একশো বছর আগেকার বিশুদ্ধ নির্মল শীতল বাতাস।

কিন্তু প্রতিবছর মহাসমারোহে আমাদের চারপাশে যে অসংখ্য চারাগাছ রোপণ করা হয়, তাদের মধ্যে কয়জনই বা একদিন বিরাট মহীরুহরূপে বেড়ে উঠতে পারে? ঘটা করে লাগানো চারাগাছগুলোকে দিনের পর দিন নানা প্রতিকূলতা, ঝড়ঝাপটা থেকে সযত্নে আগলে রাখার জন্য আদৌ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি? বর্তমানে আমাদের রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষার হালও ধুঁকতে থাকা ধরিত্রীমায়ের মতোই এবং শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা রোপণের পরে বেমালুম ভুলে যাওয়া সেইসব অগণিত চারাগাছের মতো। যাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। মনে রাখে না।

আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাব্যবস্থার এহেন ক্ষয়িত রূপ আমরা কি দেখেছি এর আগে? আঘাতের প্রসঙ্গেই মনে পড়ে গেল আঠারোদিনব্যাপী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মহারথীদের হাতের এক একটা হেভিওয়েট অস্ত্রের কথা। একটার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে অন্যটার গুঁতোয় ধরাশায়ী। সে কোভিড ১৯ অতিমারিই হোক অথবা স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে মাত্রাছাড়া দুর্নীতি। এসবের জের টেনে সবদিক থেকেই চূড়ান্তমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর বিশেষত তারা যাদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি। অর্থাৎ আমাদের ছাত্রছাত্রীরা।

করোনাকাল আমাদের তথাকথিত প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। একদল শিক্ষকের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও অনলাইন ব্যবস্থায় পড়াশোনা এবং পরীক্ষাপদ্ধতির পরিকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলোকে অতিক্রম করা যায়নি এবং ফাটলগুলো ক্রমাগত বড় হয়েছে। কথা হচ্ছিল ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানের কাছাকাছি একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষকের সঙ্গে। একে তো প্রলম্বিত গরমের ছুটি। সিলেবাস শেষ করাই দায়। তাছাড়া পড়াবেনই বা কাদের? মাত্র গত কয়েকটা বছরেই এলাকার স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমেছে। করোনার পরে স্কুলে আসা বাদ দিয়েছে চা বাগান এলাকার মেয়েরা। ওরা বেছে নিয়েছে ঘরকন্না বা বাগানে পাতা তোলার কাজ। ছেলেরাও মেশিনে পাতা ছাঁটে, পাতা তোলার গাড়ি চালায় অথবা বাইরে দিনমজুরি খাটতে যায়।

একই চিত্র অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগসুবিধে পাওয়া শহরাঞ্চলেও। কোভিড পরবর্তী নিউ নর্মালে আমরা চমকে উঠেছি সরকারি স্কুল ও কলেজগুলোয় স্টুডেন্টদের শিক্ষাগত ধ্যানধারণার মাত্রাতিরিক্ত অবনতিতে। না, শুধুমাত্র শিক্ষার মান নয়, নৈতিক অধঃপতনও বটে। ব্লেন্ডেড মোডের টেকনলজি নির্ভর পঠনপাঠনের সীমাহীন সুযোগসুবিধেগুলোর দিকে মন না দিয়ে গোটা সিমেস্টারজুড়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অফলাইনে অর্থাৎ ফিজিক্যালি ক্লাস করার পর একদল ছাত্রছাত্রীর অনলাইন ব্যবস্থায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধর্নায় বসা, কন্ট্রোলার অফিস ঘেরাওয়ের উদ্যোগ, এসব নানা অন্যায্য দাবির সাক্ষী থেকেছি আমরা।

এর সার্বিক ফলাফল যে কতটা খারাপ হতে পারে তা দেখা গিয়েছে এবছর ইউজি সিমেস্টারের রেজাল্ট বেরোনোর পর। জোঁকের মতো শরীর মন আঁকড়ে ধরা অফলাইন পরীক্ষার ভীতি, রেফারেন্স নোটের সাহায্য ছাড়া বিষয়টার মুখোমুখি হওয়ার দ্বিধা, এগুলো যতই অভ্যেসের পর্যায়ে চলে গেছে, দিনে দিনে তা কাটিয়ে ওঠাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। দেদার ফাঁকি দিয়ে, অনলাইন পরীক্ষাব্যবস্থাকে ঢাল বানিয়ে অনায়াসে আশি নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া সেইসব ছাত্রছাত্রীই মুখ থুবড়ে পড়েছে সর্বভারতীয় মানের পরীক্ষায় অথবা ইন্টারভিউতে।

জলপাইগুড়ির একটি কোএড কলেজের অধ্যক্ষের মুখে শোনা গেল শ্বাসরুদ্ধকারী খবর। গত কয়েক বছরে জেনারেল লাইনে পড়তে আসা স্টুডেন্টদের সংখ্যা নাকি ক্রমশই কমছে। সাবজেক্টের গভীরে যেতে নয়, সবাই এখন স্কিল বেসড পড়াশোনায় আগ্রহী। তবেই যদি পেট চালানোর রাস্তা মেলে ভবিষ্যতে। নার্সিং-ফার্মাসিস্ট-ফিজিওথেরাপিস্ট-ইলেক্ট্রিশিয়ান-মোটরমেক্যানিক-রিসেপশনিস্টের কাজ শেখার তুমুল আগ্রহ। আগে যেখানে অনার্সের সিটগুলোর জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত, সেখানে মেজর কোর্সের মেরিট লিস্ট বের করে হতাশ কলেজ কর্তৃপক্ষ। ভর্তির সময়সীমা বাড়িয়েই চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। তবুও সবগুলো সিট ফিলআপ করাটাই এখন মস্ত চ্যালেঞ্জ।

সামগ্রিক শিক্ষার অবনয়নের নমুনা শোনা গেল শিলিগুড়ির প্রতিষ্ঠিত কলেজের এক অধ্যাপকের কাছে। ইংরেজি অনার্সের স্টুডেন্ট অথচ একটা নির্ভুল অ্যাপ্লিকেশন লিখতে পারে না। কেমিস্ট্রি হোক অথবা সোশিওলজি- আসলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। রিসার্চেও ঝোঁক কমছে। আগে যেখানে মেধাবী ছেলেমেয়েদের একটা সিংহভাগই চলে যেত গবেষণা করতে, ধীরে ধীরে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার ফাঁদে সেই কঠিন ও শ্রমসাধ্য পথটাকে ছেড়ে দিয়ে শর্টকাট মেথডে রোজগারের পথ খুঁজছে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম।

একটু আগে ছাত্রছাত্রীদের একাংশের মধ্যে নৈতিকতার অভাবের কথা বলছিলাম। তার দায় কি একা ওদের? সমাজের সর্বস্তরেই এখন দুর্নীতি। বর্তমান টেকস্যাভি প্রজন্মের কাছে যা আর গোপন রাখা সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত এসব দেখতে দেখতেই ওরা বড় হচ্ছে। সোজাপথে জুটছে না কর্মসংস্থান। নীতিবোধশূন্য ক্ষয়িষ্ণু সমাজে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তাই হতাশা আসা স্বাভাবিক। এই জটিল পরিস্থিতিতে তাদের কীভাবে উদ্বুদ্ধ করবেন শিক্ষকরা? তাঁরা নিজেরাই যখন কালিমালিপ্ত? স্টুডেন্টদের পড়াশোনায় মোটিভেট করা তো দূরের কথা, ওদের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও এখন ভয়ানক সংকোচ হয়। বিগত প্রায় তিন বছর ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ, কনকনে শীত অথবা ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ধর্মতলায় গান্ধিমূর্তির নীচে বসেছিলেন ২০১৬-এর এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা শুধুমাত্র হকের নিয়োগের দাবিতে। কী হল সেই সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফলাফল?

সম্প্রতি কারোই অজানা নয় যে, নিয়োগ দুর্নীতির জন্য গোটা প্যানেলটাই এখন অনিশ্চয়তার মুখে। যার ফলে বহু স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকবে। স্কুলগুলো এবার চলবে কীভাবে বোঝা যাচ্ছে না। নতুন নিয়োগ কবে হবে কেউ জানে না। অনেক যোগ্য প্রার্থীর আবার নতুন করে পরীক্ষা দেওয়ার বয়সটাও গেছে পেরিয়ে। থলি ভরে ভরে টাকা নিয়েছে যারা, সেইসব উঁচুপদের ভ্রষ্ট ন্যায়নীতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের পাশাপাশি একইসঙ্গে সরকারি চাকরির লোভে পড়ে টাকা দিয়ে বেআইনি পথে চাকরি জোটাতে যাদের বিবেকে একটুও বাঁধেনি অথবা দিনের পর দিন ভদ্রসভ্য চাকরি জোগাড় করতে অক্ষম দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কয়েকজন, দোষ সকলেরই। সুতরাং কড়া হাতে এই দুর্নীতি দমনের যে প্রয়োজন ছিল সেটা অস্বীকার করা যায় না।

কিন্তু যাঁদের প্রকৃতই সৎপথে চাকরি হয়েছে, যাঁরা কোনওরকম বেআইনি কাজেই জড়িত নন, বরং স্কুলগুলোতে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের একশো শতাংশ উজার করে পড়িয়ে আসছিলেন বিগত পাঁচ-ছয় বছর ধরে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে সত্যিই তাঁদের বড় অভাব। সে অনটন কেউ পূরণ করতে পারবে না। এমনিতেই কোভিডকালে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা অনভ্যাসের দরুন নিজেদের নামটাও লিখতে ভুলেছিল, তার উপরে দীর্ঘদিন সরকারি স্কুলগুলিতে রয়েছে শিক্ষকের ঘাটতি। হাতিয়ার কেবল মিড-ডে মিল আর কিছু স্কলারশিপ। যা খুঁজে দিতে পারেনি প্রকৃত সমাধানের পথ। এর ফলে যা হওয়ার তাই হবে। স্কুল-কলেজছুটের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।

ধীরে ধীরে অন্ধকার এক ভবিষ্যতের দিকেই এগিয়ে যাবে এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা। যে অপরিমেয় সম্ভাবনা ছিল কচি চারাগাছগুলোর একদিন বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার, তারা পথপ্রান্তে দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকবে অসহায়ের মতো। দুর্নীতির ছায়াতলে লালিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মানেরও অবনমন ঘটবে অবধারিতভাবেই। পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হবে কর্মসংস্থানের নৈরাজ্যকর গাঢ় ছায়া। এরই মধ্যে আরও একটা ভোট আসবে। ছাত্রছাত্রীদের ভালোমন্দ নিয়ে এত ভাবার সময় কারই বা আছে?

(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। সূর্য সেন কলেজের অধ্যাপক) 

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

Accident | গভীর রাতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, লরির ধাক্কায় মৃত্যু ৫ জনের

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় (Accident) মৃত্যু হল ৫ জনের। শুক্রবার গভীর রাতে ঘটনাটি…

29 mins ago

West bengal weather update | শনিবারও বৃষ্টির সম্ভাবনা, আগামী সপ্তাহে ফের বঙ্গে হাওয়া বদলের ইঙ্গিত

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: গত কয়েকদিনের তীব্র গরমের পর এই আবহাওয়া বেশ উপভোগ করছেন রাজ্যবাসী।…

56 mins ago

Arvind Kejriwal | শনিবার থেকে জোর ভোট প্রচারে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, দিনভর কী কর্মসূচি রয়েছে তাঁর?

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ৫০ দিন পর অন্তবর্তী জামিনে শুক্রবার মুক্তি পেয়েছেন দিল্লির আবগারি দুর্নীতি…

1 hour ago

Panchanan Barma | রেজিস্ট্রার সাসপেন্ড হতেই দিনভর নাটকীয়তা পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে স্থগিতাদেশ রাজ্যের

কোচবিহারঃ কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের দ্বন্দ্ব কিছুতেই মিটছে না। এ যেন অনেকটা…

11 hours ago

Accident | গাড়ির ধাক্কায় পথচারীর মৃত্যু, প্রতিবাদে রাজ্যসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ গয়েরকাটায়

গয়েরকাটাঃ শুক্রবার রাত নটা নাগাদ গয়েরকাটা বানারহাট রাজ্য সড়কের উপর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির।…

11 hours ago

FIR against dowry | ৪০ দিনে দায়ের ১০ অভিযোগ, পণের দাবিতে অত্যাচারের বাড়বাড়ন্ত শিলিগুড়িতে

শিলিগুড়ি: শহর আধুনিক হয়েছে। তবে পণ প্রথা কি দূর হয়েছে? উত্তরটা বোধহয় ‘না’। শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন…

11 hours ago

This website uses cookies.