প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মাতুলালয় বা মামার বাড়ির কয়েক বিঘা জমি ও পারিবারিক মন্দির প্রাঙ্গন অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার এই অভিযোগ তুলে ধরেন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা নির্বাচনি কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। ঝাড়খন্ডের দেওঘরের কাছে কুণ্ডায় স্থিত শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পারিবারিক দেবোত্তর সম্পত্তি, যার মধ্যে মাতা কুণ্ডেশ্বরীর মন্দির অন্যতম, বিক্রি করে দিয়েছে জমি মাফিয়ারা-এমনই অভিযোগে সোচ্চার হয়েছেন বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবে, যা নিয়ে রীতিমতো সাড়া পড়েছে ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গেও।
এই মর্মে সরাসরি ঝাড়খন্ড মুখ্যমন্ত্রী এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো হেমন্ত সোরেনকেও নিশানা করেছেন নিশিকান্ত। তাঁর অভিযোগ, ‘এই ঘটনায় সরকারি যোগ-সাজোশ অবধারিত। সরকারি মদত না থাকলে কারও পক্ষে দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি বা লেনদেন করা সম্ভব নয়৷ যা কিছু হয়েছে তা সম্পূর্ণ ঝাড়খন্ড সরকারের পরোক্ষ মদতেই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের সকলের আরাধ্য৷ তাঁর বাণী আজও দেশের সর্বত্র পূজিত৷ এহেন প্রাত:স্মরণীয় ব্যক্তির স্মৃতি বিজরিত জমি কিভাবে জমি মাফিয়াদের হাতে চলে যায় তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঝাড়খন্ড সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে আমি নিজে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বারস্থ হব, তাঁর হস্তক্ষেপ চাইব। কোনওভাবেই ঠাকুরের স্মৃতির অবমাননা হতে দেবো না।’
অতীতে, বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে বেশ কয়েকবার সংসদের অধিবেশনে লোকসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন প্রান্তে জমি মাফিয়াদের অবৈধ ও অপরাধমূলক কুকর্ম এবং তার নেপথ্যে ঝাড়খণ্ড সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতের অভিযোগ তুলেছিলেন। এবার সেই জমি মাফিয়াদের হাতেই বিক্রি হয়েছে দেওঘরের কুন্ডা এলাকায় ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতি বিজরিত মাতুলালয়ের জমি, এমন অভিযোগে টুইট করেছেন নিশিকান্ত নিজেই৷ সোমবার নয়াদিল্লি থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সরাসরি তাঁর প্রশ্ন, ‘আপনাদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের আর কী পরিচয় দেওয়ার আছে? ওনার মাহাত্ম্য আপনারা সবাই জানেন৷ এহেন যুগপুরুষের মামাবাড়ির জমি যেখানে ঠাকুর নিজে দিনের পর দিন সময় কাটিয়েছেন, পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দও এসেছেন সেই দেবোত্তর জমি কী করে জমি মাফিয়ারা বিক্রি করতে পারে?’ দুবের প্রশ্ন, ‘এই জমির ল্যান্ড পজিশন সার্টিফিকেট বা এলপিসি কীভাবে ইস্যু করলেন স্থানীয় কালেক্টর? তিনি তো জানতেন এই জমি দেবোত্তর সম্পত্তি, তাহলে কিভাবে তা বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়?’
নিশিকান্তর অভিযোগ পৌঁছে গিয়েছে দেওঘরের রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কাছেও৷ এই প্রসঙ্গে সংস্থার প্রধান, সেক্রেটারি মহারাজ স্বামী জয়ন্তানন্দ বলেন, ‘আমরা অভিযোগটি শুনেছি৷ বিষয়টি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক৷ যে স্থানটির কথা বলা হচ্ছে তা আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধার৷ এখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মামাবাড়ি ছিল৷ তিনি নিজে বহুবার এখানে এসেছেন এমনকি স্বামী বিবেকানন্দও এই জমিতে এসেছেন৷ এহেন দেবোত্তর জমি নিয়ে তৈরি বিতর্কের অবসানের জন্য সচেষ্ট হব আমরা৷’ প্রয়োজনে অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়ে জরুরি আইনি পরামর্শ নেওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা, জানিয়েছেন স্বামী জয়ন্তানন্দজি মহারাজ। গোড্ডার বিজেপি সাংসদের অভিযোগ যে রীতিমত উদ্বেগের তা গোপন করেননি দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন প্রধান স্বামী জয়ন্তানন্দ৷ এই মর্মে দেওঘর জেলাশাসক তথা বেলুড় মঠ ও মিশনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তাঁরা, জানানো হয়েছে দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনের তরফে৷
প্রসঙ্গত, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ঝাড়খণ্ডের মাতুলালয় নিয়ে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রথম একটি মনোজ্ঞ প্রতিবেদন লিখেছিলেন বিশিষ্ট গবেষক তড়িৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘শ্রীরামকৃষ্ণের মাতুলালয় শ্রীধাম সারাটি’ শীর্ষক সেই নিবন্ধে তড়িৎবাবু উল্লেখ করেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেদের মাতুলালয়ের বংশের আদিপুরুষ ছিলেন দাশরথি বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর পুত্র নন্দকিশোর ও তস্য জায়া হরবিলাসিনীর তিন সন্তান – চন্দ্রমণি, রাইমণি এবং কৃষ্ণমোহন। এর মধ্যে ওলাওঠায় রাইমণির মৃত্যু হয়েছিল শৈশবকালে৷ কন্যা চন্দ্রমণির সঙ্গে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে দেন নন্দকিশোর৷ চন্দ্রমণি-ক্ষুদিরামের পাঁচ সন্তানের অন্যতম গদাধর বা শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর মামা কৃষ্ণমোহন ছিলেন সদব্রাক্ষণ, শাস্ত্রজ্ঞ ও পরোপকারী পুরুষ। ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ তিনি বাঁকুড়ার সারাটি ছেড়ে দেওঘরের নিকট কুণ্ডায় সপরিবারে চলে আসেন ও যজমানির কাজ শুরু করেন। এখানে মা কুণ্ডেশ্বরী মন্দিরে তিনি ছিলেন প্রধান উপাসক, ছিল তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি-জমিজমাও, পরবর্তী কালে যা মন্দিরকল্পে দান করে দেন কৃষ্ণমোহন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে তাঁর শৈশবকালে এই অঞ্চলে মাতুলালয়ে এসেছেন, অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনের তরফেও এই পবিত্র স্থানটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো৷ অথচ জমি মাফিয়ারা এবার সেই অঞ্চলকেও নি:শব্দে বিক্রি করে দিয়েছে বলেই অভিযোগ জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে।