সানি সরকার, শিলিগুড়ি : যুক্তির সঙ্গে বিশ্বাসের লড়াই। ঈশ্বরকে নিবেদনের নামে হাড়িকাঠে ছটফট করতে থাকা পশুটার গলা এক কোপে ছিন্ন করে দেওয়া আদৌ পুজোর অঙ্গ, নাকি তার আড়ালে নৃশংসতা- এনিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে, চিন্তাধারার বদল যে হচ্ছে তার প্রমাণ থাকছে এবার কালীপুজোয়। উত্তরবঙ্গে অন্যতম জাগ্রত বলে পরিচিত সেবকেশ্বরী কালীর পুজোয় এবছর থেকেই বন্ধ হচ্ছে বলিপ্রথা। আর সেটা সহমতের ভিত্তিতেই।
ভক্তদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেবক কালী মন্দির কমিটি। মন্দির কমিটির সহ সভাপতি স্নেহাশিস রায় বলেন, ‘আদালতের নির্দেশের পর বলিপ্রথা বন্ধের জন্য বারবার প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছিল। কিন্তু মানসিকভাবে অনেকেই তা মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে সকলের সঙ্গে আলোচনার পর বলিপ্রথা বন্ধের ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’ পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের সবজি এবং ফল বলি হবে বলে জানান মন্দিরের পুরোহিত স্বপন ভাদুড়ি।
ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট বলছে, সেবকেশ্বরী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৩০ সালে। সেই হিসাবে ৩০০ ছুঁইছুঁই বয়স এই মন্দিরের। মন্দিরের সূচনালগ্ন থেকেই এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী। তাঁর বাৎসরিক পুজোর দিন সেবকে ভক্তদের ভিড়টা উপচে পড়ে। শিলিগুড়ি শহর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাস চলাচল করে সেবকেশ্বরীর মন্দির পর্যন্ত। এই পুজোর অন্যতম আচার ছিল পশুবলি। রক্তস্রোতে ভেসে যেত মন্দির। শুধু কালীপুজোর দিন নয়, বছরের অন্য সময়েও মানতের বলি হত এই মন্দিরে।
মন্দির কমিটির এক সদস্য জানান, পশুবলি বন্ধ করার জন্য আদালত নির্দেশ দেওয়ার পরেও দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এখানে আসেন বলির জন্য। ফলে দিন-দিন পশুবলির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তবে এবছর থেকে যে আর বলি দেওয়া যাবে না, ফোন করে সেকথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলি বন্ধের নির্দেশিকা মন্দিরের চত্বরে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মন্দির কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কালীপুজোর দিন এবং পরের দিন মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০টি পাঁঠা বলি হত। বছরের বাকি দিনগুলি মিলিয়ে সংখ্যাটা দেড়শোর কাছাকাছি। কালীপুজো ছাড়াও অমাবস্যা, পূর্ণিমার পাশাপাশি শনি ও মঙ্গলবার এখানে বলি হত। তবে বলি বন্ধ হলেও মায়ের নামে পাঁঠা বা অন্য পশু উত্সর্গ করা যাবে বলে জানান মন্দির কমিটির সহ সভাপতি।
সেবকে কালী মন্দিরটি গড়ে তোলেন সেচ দপ্তরের কর্মী ময়নাগুড়ির বাসিন্দা নীরেন সান্যাল। এখন যেখানে সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের অফিস রয়েছে, সেখানেই আগে ছিল সেচ দপ্তর। কথিত রয়েছে, এখানে কর্মরত অবস্থায় দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্নাদেশ পান নীরেন সান্যাল। ওই স্বপ্নাদেশের পরই পাথরের মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেন তিনি। ক্রমশ মন্দিরে ভিড় বাড়তে থাকে পুণ্যার্থীদের। বর্তমান মন্দিরটি ‘রিলিজিয়াস টুরিজম ডেস্টিনেশন’ হিসাবে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইটে ঠাঁই পেয়েছে। জানা গিয়েছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মন্দিরে পশুবলি হয়ে আসছে। তবে ১৯৭৬ সালে মন্দির কমিটি গঠনের পর কমিটির তরফে কোনও বছরই বলি দেওয়া হয়নি।
বর্তমানে মূলত পুজোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিন পুরোহিত। তাঁরা হলেন স্বপন ভাদুড়ি, নন্দ গোস্বামী ও লক্ষ্মণ ভাদুড়ি। এছাড়াও পুজোর জোগাড় এবং মায়ের ভোগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তপন গোস্বামী। বলিপ্রথা বন্ধ হওয়ায় তাঁদের কারও মনেই ক্ষোভ নেই।