- পরাগ মিত্র
দুয়ার এঁটে পাড়া গভীর ঘুমে। ডিসিআরসি-তে গাড়ির গাদায় পিলপিল করে ঘোষিত নম্বরপ্লেট খুঁজছেন যাঁরা, কেউ যাবেন সিতাই থেকে বাণেশ্বর, কালচিনি থেকে চামটা…। সিট পেলে ভাগ্যবান। অভাজনের আবার খোঁজ। বাসুকির লেজের মতো জ্যামে মিশে গাড়ি এরপর তেল ভরবে। বাসরুটের কাছে বাড়ি যার, সে সিকন্দর। কিন্তু প্রান্তে যার বাড়ি রাত কাটে পথেই। রাজা আসে যায়, রাজ অভিষেকের নিমিত্তে একদিনের ‘অফিসার’ ভোটবাবুর দুর্ভোগ অম্লান।
ফেরাই একমাত্র সমস্যা হলে প্রশ্ন ছিল না। চারজনের দলকে রিসিভিং সেন্টারের উদ্দেশ্য নিজেদের পোশাক, বিছানার পোটলার সঙ্গে লটবহরে বইতে হবে ভোটিং ইউনিটের বাক্স, ব্যালট ইউনিট, কার্ডবোর্ড, নানা খাম (কপালে থাকলে সিলড খাম আবার খুলে সিল) খানচারেক বস্তা, টুকিটাকি… সবই । সেই পথের চেয়ে মরুতীর্থ হিংলাজ সহজ। রাস্তা ব্লক। গাড়ি ন যযৌ ন তস্থৌ। ধৈর্য চুলোয় যায়, গাড়ি থেকে নেমে এক-দুই কিমি হেঁটে কাউন্টারে আবার লাইন। ক্লান্তি, ওষুধ এখন মনে আনতে নেই।
শঙ্কা বাড়ে ডাক এলেই। টিম, জায়গা, নিরাপত্তা…। ট্রেনিং-এর আশ্বাস আর বাস্তবতার সম্পর্ক চিরকালীন বিপ্রতীপ। ভোটের আগের দিন সাতসকালে রওনা। চাকরি ও আবাস বাদ দিয়ে অন্য জেলা, মহকুমার উদ্দেশে। কোডিং শেষে মুখশ্রী বলে দেয় কার গন্তব্য কিতনে দূর। লাইনে দিয়ে সব সংগ্রহ, ঘাসে বসে মিলিয়ে আবার পুলিশের জন্য লাইন শেষে গাড়ি। সব টিম এলেই গাড়ি যাবে। শনি কৃপা করলে প্রথম দলকে সবার শেষে চত্বর ছাড়তে হয়। রিজার্ভে চুপকে চুপকে থেকেও কেউ শ্যেন নজরে পাকড়াও হয়ে যান। রাহু তাকালে রাতগভীর বা ভোটের শেষ বেলাতেও রিজার্ভের ‘ডিউটি’ জোটে।
বুথ সাজিয়ে, কাগজ গুছিয়ে সটান মেঝে। উৎকণ্ঠায় বিনিদ্র চোখ। শেষরাতে স্নানটান নমো-নমো। ভোট সাতটায়। মক পোল সাড়ে পাঁচ। পোলিং এজেন্ট না পৌঁছালে শুরুর নির্দেশ থাকে, তবে ঘাড়ে তো একটাই মাথা! শেষবেলায় লাইন পড়লে সময় অনির্দিষ্ট। মধ্যাহ্নভোজন তো দূর, টিফিনের জন্যও কোনও সময় লেখা নেই। ম্যানেজেই শরণং। হাওয়া গরম হলে ‘ম্যানেজের’ও দফারফা। ফোন এলে ধরাস পরাণে ‘ঠিক আছে’ আওড়ানো। দ্রুত গুছিয়েও লাভ নেই। ফিরতে হবে অন্যদের সঙ্গেই।
অবস্থার পরিবর্তন কি দুঃসাধ্য?
বুথের ২০০ মিটারের মধ্যে দলীয় চিহ্ন নিষিদ্ধ। থাকলে? প্রিসাইডিং চুনকাম করবে? সেক্টরকে দোষ? ভোট দু’দিনের। ওই এলাকাতেই তারও অফিস। পোলিং টিমের জন্য বুথে ম্যাট্রেস, মশারি জোগানো, টিফিনের জন্য সময় বরাদ্দ অসম্ভব? আগের থেকে বুথ সাজাতে বাঁধা আছে? যাঁদের রাত হল, তাঁদের জন্য অন্তত ঢালাও বিছানা শাস্ত্রে মানা? দরকারি কাগজপত্র বাদে, যেমন ভোটকক্ষের কার্ডবোর্ড, অন্যান্য জিনিস জল্পেশ থেকে জলপাইগুড়ি টানার চেয়ে বুথেই পৌঁছানো ও ফেরত দুই-ই হোক।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কে কোথায় যাচ্ছে জানানো কঠিন? সেক্টর থেকে ডিএম সবাই নিজের জায়গায়, তাহলে বুথের ভোটকর্মীদের জেলা, মহকুমা বদল করে চালানের হ্যাপা কেন? পরের দিন ছুটি নয়, অফিস। মানুষ না গ্ল্যাডিয়েটার? কর্তা রিপোর্টেই তুষ্ট। হুকুম বদলায় না।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক)