- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
জায়গাটার নাম পলাশ। কার্যত একেবারে শিলিগুড়ির মধ্যেই। অথচ শহরের অনেককেই জায়গাটা নিয়ে প্রশ্ন করলে শুনি, কোথায় পলাশ? কোথায় পলাশ?
তা সরস্বতীপুজোর সকালে পলাশে গিয়ে আবার উপলদ্ধি হল, শিলিগুড়ির হৃৎকমলে যে নতুন শিলিগুড়ি বাসা বেঁধেছে, তা শহরের কর্তারা অস্বীকার করছেন। জেনেবুঝেও চুপ। মোদি-মমতার স্টাইলেই গৌতম দেব-পাপিয়া ঘোষেরা ভোটের মুখে শোনাচ্ছেন নতুন নতুন প্রকল্পের কথা। তবে কোনও কিছুই পরিকল্পনা করে, দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা মাথায় রেখে হচ্ছে না। মালদা-কোচবিহার-রায়গঞ্জের মতো শহরগুলোতেও কথাটা খাটে।
চম্পাসারি থেকে যে পথ গুলমা স্টেশনের দিকে চলে গেল, একটু এগিয়ে ডানদিকের গলি নিলেই পলাশবস্তির রাস্তা। খাতায়-কলমে গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে, বাস্তবে পুরো শহর। সে পথে পলাশ নেই আর। ঘুরতে ঘুরতে যে পথ বসন্তে মৃতপ্রায় মহানন্দা নদীর সঙ্গে মিশে যায়, তা জুড়ে নানারকম বাড়ি। দক্ষিণ পলাশ, মধ্য পলাশ, উত্তর পলাশ- সব মহল্লায় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি, ভাঙা বিবর্ণ বাড়ি। বিশাল মাঠ খুঁড়ে বসতি বানানো হচ্ছে সব। বড় ধুলো হে চারদিকে। তার মাঝে এদিক-ওদিকে উঠে গিয়েছে বাসস্থান, পরিকল্পনার চিহ্ন নেই কোথাও। রাস্তার ধারে অনেক টিউবওয়েল শুকনো, জলের চিহ্ন নেই।
অবাক লাগল, সরস্বতীপুজোর দিন দক্ষিণ পলাশ প্রাথমিক স্কুল একেবারে জনশূন্য তালাবন্ধ পড়ে। ৪৫ বছরের স্কুল, পুজোই হয় না বোঝা যাচ্ছে। চারদিকের বাড়ির ছাদে শুধু রাম আর হনুমানের ছবি লাগানো পতাকা। কোনওটা গাঢ় লাল, কোনওটা গেরুয়া। স্পষ্ট, এলাকায় ভিনরাজ্যের লোকেরা এসে বসে গিয়েছেন। মহানন্দার সামান্য দূরে ধুলিধূসরিত গলির ভিতরে একটা বাড়ি। ভরদুপুরে দুই বালিকা উঠোনের মধ্যে পড়াশোনা করছে মাদুর পেতে। তাদের বাড়িতেই দোতলায় এক কালী মন্দির। এমন কালী দেখিনি আগে। ঘোড়ার ওপর বসে শাড়ি পরা মা কালী। বালিকাদের মা বললেন, ভদ্রকালীর মূর্তি। তাঁর পাশে শ্মশানকালীর মূর্তিও রয়েছে। সব বানানো ওই ছোট্ট বাড়িতেই। এঁরা অনেক বছর আগে এসেছেন বিহারের চম্পারণ থেকে। ভাবুন, চম্পারণ থেকে বাংলার পলাশে!
আবার লিখি, সরকারের খাতায়-কলমে না থাকুক, ওই জায়গাটা শিলিগুড়িই হয়ে গিয়েছে। ঠিকানায় লেখা থাকছে, চম্পাসারি, শিলিগুড়ি। হবে নাই বা কেন? কত দূর আর শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন থেকে? এই সব এলাকার কথা নেতাদের মনে পড়বে শুধু ভোট এলে এবং লোকসভা ভোটের জন্য এখন এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন গুরুত্বপূর্ণ মহানন্দা পাড়ের অসংখ্য বেআইনি বাড়ি মালিকদের তোয়াজ করে চলে যাওয়া। সে শিলিগুড়িই হোক বা মালদা। গৌতম দেব থেকে শংকর ঘোষ, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী থেকে শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী- সবার এক নীতি। চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন ভাই। একদা যা করে গিয়েছেন অশোক ভট্টাচার্য বা শৈলেন সরকাররা।
ভোটের আগে দেশজুড়ে এত প্রকল্পের ঢেউ দেখে আপনার কি মনে হয় না, এখনও সব সরকার জনতাকে বোকাসোকাই ভাবে? ভাবে, কেউ বুঝতে পারবে না, এতদিনে এত কাজের কথা মনে পড়ল কী করে এবং শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করলে যা হয়। ডিএমকে সরকার চেন্নাইয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার বদলে দিয়ে দিচ্ছে চিনের পতাকা। শিলিগুড়িতে পুরসভা ‘কিরণ’ বানান বড় বড় করে ভুল লিখে দিচ্ছে। কেন্দ্রের বিজ্ঞাপনেও অনেক ভুল বানান।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেদিন দেশের ৫৫৩ রেলস্টেশনে ১৯ হাজার কোটির নতুন প্রকল্পের শিলান্যাস করলেন। ২১ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় রোডব্রিজ, আন্ডারপাসেরও শিলান্যাস হল ভারতজুড়ে। মমতা সরকারও অনেক কিছু শিলান্যাস করছে দেখাদেখি। এখানে প্রশ্ন দুটো। এক, এতদিন ঝুলিয়ে রেখে ভোটের মুখে এত শিলান্যাস করে লাভ কী। দুই, এই প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ কী? অধিকাংশই অর্ধেক অবস্থায় পড়ে থাকবে না তো? শিলিগুড়ির পলাশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে অর্ধসমাপ্ত পরিকাঠামো পড়ে থাকে।
গুলমা রেলস্টেশনের কথাই ধরুন না প্রিয় পাঠক। সারাদিনে সেখানে থামে তিন জোড়া ট্রেন। শূন্যতা সারাদিন জুড়ে থাকে প্ল্যাটফর্মে। সেখানেও দেখি মোদির ‘ওয়ান স্টেশন, ওয়ান প্রোডাক্ট’ দোকান। দোকান আছে। তবে সম্পূর্ণ বন্ধ। কোনওদিন খোলেইনি। কেন খুলবে? কে আসবে? বারসইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এরকম ওয়ান প্রোডাক্টের দোকান দেখেছি রুটিন স্টলের মতো হয়ে উঠেছে। কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট, চিপস সব পাওয়া যাচ্ছে। মানে অতি পরিষ্কার। যে প্রতিশ্রুতিমালার ঢাকঢোল পিটিয়ে কেন্দ্র এবং রেলের তরফে দোকান করা হল, তার কিছুই পূর্ণ হয়নি বাস্তবে।
পলাশ-গুলমা-বারসইয়ের মতো অনেক জায়গা আসলে দেখায়, প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি আসলে অধিকাংশই শূন্য থেকে যায়। সব পার্টির খাতায়। সব রাজ্যেই। রংবেরংয়ের বেলুন দিয়ে সাজানো হয় প্রকল্পের মঞ্চ, শিলান্যাসের ফলক। কোথাও কমলা, কোথাও নীল বেলুন উড়তে উড়তে হারিয়ে যায় অনুষ্ঠান শেষে। প্রতিশ্রুতির বেলুনও হারিয়ে যেতে থাকে আকাশে, বাতাসে।