- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
আপনাকে তো আর বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলে সম্বোধনের দরকার নেই। অভিজিৎবাবু বলা যায়। আবার অন্য নেতাদের ঢংয়ে শুধু নাম দিয়ে দিব্যি লেখা যায়। আপনিও তো স্যর এখন এক স্রেফ নেতা। দুর্নীতির মধ্যে ডুবে থাকা বাকপটু নেতাদের এক নতুন পার্শ্বচর মাত্র।
নেতাদের মতোই প্রথম প্রেস কনফারেন্সে মোক্ষম কথাটি বলে দিয়েছেন। সাধু সাধু!
যেভাবে আপনি পার্টি বাছলেন স্যর, সেটাও লা-জবাব। শিশুসুলভেরও শিশুসুলভ। ভাবনার অতীত ছিল, এভাবেও পার্টি বাছা যায়। যেন এক বাচ্চাকে তিনটি আইসক্রিম দেওয়া হয়েছে। তারপর তাকে প্রশ্ন, তুই কী নিবি রে? চকোলেট, ভ্যানিলা, না স্ট্রবেরি ফ্লেভার? আপনি ঠিক সেভাবেই নেতা হিসেবে প্রথম প্রেস মিটে বললেন, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। ধর্ম মানি। তাই সিপিএমে যাইনি। কংগ্রেস পরিবারতন্ত্র চালায়। তাদের দলে জয়রাম রমেশের মতো শিক্ষিত মানুষ পদ পান না। তাই কংগ্রেসে যাব না। বিজেপি তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম থেকে লড়াই চালাচ্ছে, তাই বিজেপিতে যোগদান করছি।’
কী মোক্ষম উপলব্ধি! এইভাবে যে কেউ পার্টি বাছতে পারে, সেটা আপনিই আমাদের শিখিয়ে দিলেন স্যর। অন্য কেউ এভাবে পার্টি বাছলে তাঁকে লোকে সুবিধেবাদী বলত। দুয়ো দিত। কিন্তু আপনি যে স্যর ঈশ্বরের ভাবমূর্তি নিয়ে বসে। বলি সাহস আছে কার, আপনাকে কিছু বলবে?
যদি অভয় দেন, তা হলে সবিনয়ে একটা কথা বলি। ধর্ম মানেন, মানতেই পারেন। তা আপনি স্যর একেবারে চূড়ান্ত হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক মনোভাবের মানুষ তো? আপনার নতুন দল যা যা বিভেদের অঙ্ক মানে, সব দ্বিধাহীন মেনেই রাজনীতি করবেন তাহলে? এতদিন আবার সিপিএমের বিকাশ ভট্টাচার্যকে গুরু মানতেন। সবাই বলত, বিকাশের মতো আপনিও বামপন্থী। গুরুবাদ যে রাতারাতি পালটে গেল কী করে, সেটাই ভাবি।
জানেন তো, মালদার খগেন মুর্মু সিপিএম থেকে রাতারাতি পদ্মে গিয়েছিলেন সাংসদ হবেন বলে। আদর্শের ‘আ’ নেই বলে বহুনিন্দিত। আপনাকে দেখে যে খগেনের কথাই মনে পড়ছে মহাশয়। আরও বড় প্রশ্ন, হাইকোর্টে এজলাস চলাকালীন যে পর্যবেক্ষণগুলো করতেন, তা কি পদ্ম পার্টির মনোভাবের সঙ্গেই পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল? কোন আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এলেন, তা আপনার ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হল না। রাজনীতির বাইরে স্বচ্ছ থেকেই কি শাসকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও সরব হওয়া যেত না?
প্রশ্ন আরও অনেক থাকছে স্যর আপনার জন্য। যে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আপনি তৈরি করেছিলেন, তা বহু কষ্টে তৈরি হয়। দলবদলিয়ার অন্যতম গুরুঠাকুর শুভেন্দু অধিকারীর কাছাকাছি থেকে দ্রুত ভাবমূর্তির পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে না তো? রাজ্য বিজেপিতে দেখি, আপনার চক্ষুশূল পার্টি তৃণমূলেরই বেশি নেতা গিয়ে ফুটেজ খাচ্ছেন। দুই, আপনার আগের মন্তব্য ও রায়গুলোকে এখন একেবারে পূর্ব পরিকল্পনামাফিক মনে হবে না? তিন, বহু আইনজীবীই বলছেন, ভবিষ্যতে কেউ স্পষ্টাস্পষ্টি অভিজিতের ঢংয়ে কথা বললে মনে হতে পারে, এই বিচারপতির মনেও অভিজিৎ সুলভ ভাবমূর্তি গঠনের চেষ্টা রয়েছে। সব বিচারপতিকে সম্মান জানিয়ে সবিনয়ে বলি, আপনি রাজনীতিতে গিয়ে বিচারপতিদের বিশাল ক্ষতিই করে দিলেন না তো স্যর? চার, বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি নেতাদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ অনেকদিনেরই। ছুটিটা কি আরও অনেক আগে নিলে শোভন হত না? এখন অধিকাংশ লোক বলবে, ভোটে দাঁড়ানোর জন্যই (মন্ত্রী হওয়ার জন্য) এত বিপ্লবীয়ানা। কোনও পার্টিই আর ধোয়া পদ্মপাতা নয়।
যেভাবে আপনি নেতা হিসেবে প্রথম প্রেস মিটেই ‘তালপাতার সেপাই,’ ‘যাত্রাপালা’, ‘আমি ওর নাম মুখে নেব না।’ ‘দাঁড়ালে কয়েক লক্ষ ভোটে হারাব’ ‘নারদায় শুভেন্দুর নাম জড়ানো এক চক্রান্ত।’ জাতীয় কথাগুলো বলতে শুরু করলেন, তাতে স্পষ্ট, আপনার রাজনৈতিক যোগ বহুদিনের। নেতা হব, অনেক আগে থেকে না ভাবলে কেউ এ কথা বলে না। নিশ্চয়ই আয়নার সামনে প্র্যাকটিস বহুদিন করতে হয়েছে। তবে প্রথমেই এত কথা বললে আত্মঘাতী গোল, হিট উইকেট করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রথম দিনে তাই করেছেনও কয়েকটা। ও কিছু না। আপনার নতুন সতীর্থ দলবদলিয়ারা অনেকবার এসব করেছেন।
আপনি স্যর বলেছিলেন, চাকরি ব্যবস্থায় দুর্নীতির শেষ দেখে ছাড়বেন। একেবারে ঠিক বলেছিলেন, তৃণমূলে দুর্নীতির রাজনীতির শিকড় অনেক গভীরে। শেষপর্যন্ত রাজনীতির শেষ দেখতে গেলেন। গেলেন এমন একটা দলে, যেখানে তৃণমূলের মতো নীতিভ্রষ্ট, আদর্শভ্রষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্তদের ভিড়। তৃণমূলের মতো এখানেও ছড়ি ঘোরান দুর্নীতিগ্রস্তরা। বিচারপতির পদ ছেড়ে যাচ্ছেন এমন এক দলে, যাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেশের বিচার ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার নিয়মিত অন্যায় চেষ্টা চালাচ্ছেন। আপনি কী বলবেন স্যর?
আদালতে বসে করা আপনার পুরোনো পর্যবেক্ষণগুলো সত্যি সত্যিই বিজয়ীসুলভ শোনাত। অভিজিৎ মানে তো বিজয়ী। কী হেডিং হওয়ার মতো লাইনগুলো! কী সাহসী! খারাপ লাগছে স্যর, সেসব এখন আপনাকেই ব্যঙ্গ করবে বারবার। গান্ধিমূর্তি, মাতঙ্গিনীমূর্তির নীচে বসে যে চাকরিপ্রার্থীরা অসহায় ধর্না দিচ্ছেন সারা দিন, তাঁদেরও ব্যঙ্গ করবে। কেননা তাঁদের ভরসা ছিল এক ‘ঈশ্বরের’ ওপর। কথার ঈশ্বরের ওপর।
সেদিনের ঈশ্বর আজ নেতা হয়ে গিয়েছেন। শুধুই এক নেতা। ধার্মিক এক নেতা, না বকধার্মিক, সেটা আসল ঈশ্বর আমাদের জানাবেন কিছুদিন পর। ভালো থাকবেন স্যর। খুব ভালো থাকবেন। দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতালোভী নেতাদের সঙ্গে অনেকদিন গা ঘষাঘষি করে চলতে হবে তো!