কলাম

অধীর যুগে কংগ্রেসকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

কোচবিহারের কংগ্রেস প্রার্থী পিয়া রায় চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে যাবতীয় বিস্ময় গ্রাস করে। কোচবিহার শহরের রেলগুমটির কাছে বাড়ি পিয়ার। রায়গঞ্জে স্কুল-কলেজে পড়া। রবীন্দ্রভারতীতে ভূগোলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। শিক্ষকতা করেন গাড্ডারপার জুনিয়ার হাইস্কুলে। বছর তিনেকের সন্তানকে নিয়েই প্রচার চালিয়েছেন বহুদিন। কার্যত একা।

অধীর চৌধুরীর আমলে রাজ্য কংগ্রেসের দুর্দশা কী জায়গায়, তা বোঝাতে মদনমোহনের শহরের পার্টির গল্পটাই উৎকৃষ্টতম উদাহরণ।

এই যে এতদিন ধরে পিয়া প্রচার চালালেন, তাঁর সমর্থনে ভাষণ দিতে আসার সময় পাননি কংগ্রেসের কোনও বড় নেতা। এত সময় মহার্ঘ তাঁদের! রাহুল গান্ধিকে ছেড়ে দিন। না মল্লিকার্জুন খাড়গে, না অধীর চৌধুরী, না উত্তরবঙ্গের একটু পরিচিত কেউ। কত বড় বড় নেতা সব। সময়ই নেই। মুর্শিদাবাদে সেলিমের পাশে কাস্তে হাতে তারার উত্তরীয় পরে অধীর প্রচারে নেমেছেন। অথচ কোচবিহারে সিপিএমের নেতারা ছায়া মাড়াননি কংগ্রেস প্রার্থীর। প্রচার করেছেন ফরোয়ার্ড ব্লকের হয়ে।

অধীরের জোট কি তাহলে স্রেফ মুর্শিদাবাদে। তাঁর নিজের ও নতুন ‘বন্ধু’ সেলিমের জন্য?

ভোটের পরদিন কোচবিহারের অন্য একটা ছবি কংগ্রেসি ঘরানার আর একটা পুরোনো স্মৃতিও ফিরিয়ে গেল।

কংগ্রেস অফিসের দেওয়াল থেকে পিয়ার নামে দেওয়াল লিখনই মুছে দিলেন পার্টির একদল কর্মী। তাঁরা বিক্ষুব্ধ। ভোটের প্রচারে তাঁরা এক কথা বলছেন। পিয়া এবং তাঁর স্বামী এক কথা বলছেন। পার্টির অবস্থা শূন্য- কোথায় একজোট হয়ে লড়বে, তা নয়। পাঁচজন নেতার পার্টিতেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ধরে নিন, বনেদি জমিদার বাড়ি একান্নবর্তী থেকে ভাঙতে ভাঙতে দু’তিনটে পরিবারে এসে ঠেকেছে। সেই দু’তিনজনেও মারপিট চলছে। এমন ছন্নছাড়া হওয়ার দায় অধীরকেই নিতে হবে।

কোচবিহারের কংগ্রেস প্রার্থী ফোনে বলছিলেন, জেতার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। স্রেফ বলতে হয় বলেই বলা। তিনিও জানেন, ভবিষ্যৎ কোন অতলে। রাজ্যে কংগ্রেসের মাথারা এত অপদার্থ ও অযোগ্য, কোচবিহারে ছয় বছর জেলা সভাপতিই ঠিক করতে পারেননি। ছয় বছর ধরে কাজ চালাচ্ছেন কার্যনির্বাহী সভাপতি রবিন রায়। ভাবুন, ইয়ার্কি করছি না, ছয় বছর ধরে কোচবিহারের মতো জেলায় কোনও সভাপতি নেই। রবিন শুনি পিয়া এবং তাঁর স্বামীর দিকে। জেলার সাধারণ সম্পাদক মীর মোশারফ হোসেন আবার পিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গে এসে সাতদিন পড়ে থেকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করে গেলেন। অধীর কী করলেন? সব উসকেই রেখে দিলেন। আসছে বছর আবার হবে।

 এখনকার রাজনৈতিক সুবিধেবাদের পরিবেশে ক্ষমতায় না থাকলে সমর্থক ধরে রাখা মুশকিল। কংগ্রেস রাজ্যে ৪৭ বছর ক্ষমতায় নেই। কেন্দ্রে নেই দশ বছর। তারপরেও যে বাংলায় এখনও কিছু অন্ধ কংগ্রেস ভক্ত আছেন, তা অশেষ সৌভাগ্য গান্ধি পরিবারের। ২০০৯ সালে কংগ্রেস রাজ্যে ভোট পায় ১৩.৪৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে ৯.৫৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে দেখলাম, তা দাঁড়ায় ৫.৭ শতাংশ। ২০২১ বিধানসভায় ৩.০৩ শতাংশ। দশ বছরে দশ শতাংশ কমেছে। মাথাব্যথা নেই কারও। বড়িয়া হ্যায় অধীরবাবু!

 বাংলায় কংগ্রেসের ভোটারদের ধরে রাখার আন্তরিক ইচ্ছে কি দু’দফায় প্রায় আট বছর রাজ্য সভাপতি থাকা অধীর দেখিয়েছেন? সাদা ট্র্যাক সুট, সাদা টুপি পরে ন্যায়যাত্রার বাংলা অংশে তিনি কার্সিয়াং পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মাঝে একবার প্রেসমিট। ওই শেষ। দার্জিলিংয়ের প্রচারেও তাঁর টিকি পর্যন্ত দেখেনি জনতা। কলকাতার বিধান ভবনে প্রেসমিট আর মুর্শিদাবাদের ভোটেই সময় কাটিয়ে দিলে আর রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি বলা হবে কেন? এটা ঠিক, লোকসভায় বিরোধী নেতা হয়েছেন তিনি। যা যে কোনও বাঙালি রাজনীতিকের স্বপ্ন। তাতে বাংলা কংগ্রেসের লাভ কী হল বলতে পারেন?

শিলিগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গের কংগ্রেসও কোচবিহারের মতো দিশাহীন। এতদিনেও শিলিগুড়ি থেকে শংকর মালাকারের বিকল্প কোনও নেতা কংগ্রেস তুলে আনতে পারল না। সেখানেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এখন ছাত্র ও যুব সংগঠন এমন দিশাহীন, লোককে বিশ্বাস করানো শক্ত, বছর কয়েক আগেও শিলিগুড়ি কলেজে ছাত্র পরিষদের ভালো অস্তিত্ব ছিল। শংকর এবং সুজয় ঘটকের গোষ্ঠীবাজির ফলে ছাত্র পরিষদ কার্যত উঠে গিয়েছে। কালিদাস স্টাইলে এঁরাই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছেন এবং তাঁদের অস্তিত্ব নিজস্ব ওয়ার্ডেই সীমাবদ্ধ। এঁরা আর নিজেরাও বড় কোনও স্বপ্ন দেখবেন না, কাউকে বড় স্বপ্ন দেখতে দেবেন না।

অধীর-জমানায় সব জেলার কংগ্রেসেই এক অবস্থা। যেসব মধ্যমেধার মুখকে টিভিতে কংগ্রেসের মুখপাত্র হিসেবে বড় বড় তত্ত্ব আওড়াতে দেখা যায়, তাঁরা অধিকাংশ নিজের পাড়াতেই অচেনা। পাড়ায় দাঁড়ালে ভোটে জিততে পারবেন না। অনেকে কংগ্রেসের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পরিচিত হয়েছেন। সেটা ভাঙিয়ে চলে গিয়েছেন অন্য পার্টিতে। চুলোয় যাক আদর্শ। এঁদের মধ্যে অধীর-ঘনিষ্ঠরাই বেশি। এঁদের টিভিতে বলার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন কারা? একেবারে বানপ্রস্থে যাওয়া ভদ্রলোক নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যকে অযথা উত্তর কলকাতায় দাঁড় করিয়ে হেনস্তার মানেটাই বা কী?

বিনয় তামাংদের নিয়ে অধীর পাহাড়ে যে খেলাটা খেললেন, তারও কোনও ব্যাখ্যা নেই। রাজনৈতিক বুদ্ধির অভাব তো হওয়ার কথা নয়, অধীর দীর্ঘদিনের রাজনীতিক। তবে এটা একেবারে গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়ার মতো। কেনই যে বিনয়কে নেওয়া কংগ্রেসে, কেনই বা সম্পূর্ণ অচেনা মুনীশ তামাংকে প্রার্থী করে দেওয়া, তা একেবারে অবোধ্য। কোচবিহারের কংগ্রেসে বিক্ষোভ দেখে বোঝা যায়, ভাগবাঁটোয়ারার গল্প নিয়েই ঝামেলা সেখানে। হাইকমান্ডের দেওয়া টাকা কত খরচ হল, কত কার পকেটে রয়ে গেল। পাহাড়ের ক্ষেত্রে তা হলে কী বলবেন?

বলতে পারেন, অধীর তো না হয় বহরমপুর ছাড়া কিছুই জীবনে ভাবলেন না, রাহুল কী করলেন? ন্যায্য প্রশ্ন। এখনও পর্যন্ত তাঁর বা তাঁর বোনের বাংলায় আসার সময় হল না। ধরে নিয়েছেন, এখানে এসে লাভ নেই। মমতার সঙ্গে জোট তৈরির আশা ছিল বলে কংগ্রেসের প্রার্থী ঘোষণাতেও টালবাহানা করেছেন। তাতে আমও গিয়েছে, ছালাও। মালদা, মুর্শিদাবাদের সব কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়ে বিজেপিরই সুবিধে করেছেন অধীরের রাজ্য কংগ্রেস।

বাংলার গ্রামে, মফসসলে, শহরে আজও আকাশের তারার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কংগ্রেসি পরিবার। খুবই অল্প। তবু রয়েছে। বিভ্রান্তির মধ্যেই বেঁচে আছে। অধীর তীব্র মমতাবিরোধী, বিজেপির প্রতি নরম। গান্ধিরা তীব্র বিজেপি বিরোধী, মমতার প্রতি নরম। এই জাঁতাকলে পড়ে রাজ্য কংগ্রেস যে ঠিক কী করতে চায় স্পষ্ট হল না এতদিনে।

এখান থেকে কী সিদ্ধান্তে আসতে হবে? যুদ্ধ করলে হয় পুরোটা করো, সন্ধি করলে পুরোটা সন্ধি। অধীরের কংগ্রেস কিছুই জানল না। শুধু জানল বহরমপুর, দক্ষিণ মালদা আর মুর্শিদাবাদে জান দিয়ে লড়তে হবে।

কী বললেন, বিয়াল্লিশে দুই? তাই সই!

Uttarbanga Sambad

Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Recent Posts

India Tour By Bicycle | দু চাকায় ভর করে ভারত ভ্রমণ, যুবকের উদ্দেশ্য জানলে চমকে যাবেন

শিলিগুড়ি: মা দিয়েছিলেন ৫০০ টাকা। সেই ৫০০ টাকা কে সম্বল করেই দেশ ভ্রমণে (India tour)…

32 mins ago

Brown sugar seized | প্রায় ৮ কেজি ব্রাউন সুগার ও ৩২ লক্ষ টাকা সহ গ্রেপ্তার পাচারচক্রের পান্ডা

মালদা: ৭ কেজি ৯০০ গ্রাম ব্রাউন সুগার (Brown sugar seized) ও ৩২ লক্ষ টাকা সহ…

37 mins ago

Malda | ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু মালদার শ্রমিকের

হরিশ্চন্দ্রপুর: ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল মালদার (Malda) হরিশ্চন্দ্রপুরের এক ব্যক্তির (Migrant Worker…

54 mins ago

Lok Sabha Election 2024 | বিজেপি কর্মীর কান কেটে নেওয়ার অভিযোগ, কাঠগড়ায় তৃণমূল

কাঁথি: এক বিজেপি কর্মীর কান কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠল। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের ঘটনা। আক্রান্তের নাম…

58 mins ago

Huge cash recovered | আয়কর দপ্তরের অভিযানে বিপুল টাকা, কেজি কেজি সোনা উদ্ধার

উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ১৭০ কোটি টাকা! মহারাষ্ট্রের (Maharashtra) নান্দেড়ে আয়কর দপ্তরের অভিযানে উদ্ধার হল…

1 hour ago

Tea Garden | মেলেনি বেতন, কর্মবিরতিতে শামিল হল নাগেশ্বরী চা বাগানের কর্মীরা

মেটেলি: নির্দিষ্ট সময়ে বেতন (Salary issue) না মেলায় চা বাগানের (Tea garden) স্টাফ ও সাব…

1 hour ago

This website uses cookies.